মেঘময়ী পুষ্প বিতান

নিরব ও শেহতাজ। ছবি: ছুটির দিনে
নিরব ও শেহতাজ। ছবি: ছুটির দিনে

ঢাকা শহরে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে এই অফিস থেকে ওই অফিসে ছুটে বেড়ানো যুবকগুলোর একটি করে করুণ গল্প থাকে। সেই করুণ গল্প আর একটি ক্রমশ ধূসর হওয়া স্বপ্ন যুগপৎ চলতে থাকে। আনিসের গল্পটি ব্যতিক্রম কিছু নয়।

আনিস এর আগে দশটি চাকরির সাক্ষাৎকার দিয়েছে। সে এখন এসেছে এগারোতম সাক্ষাৎকার দিতে। এবারও যে চাকরি হবে না, তা জানা কথাই।

আনিস এখন সাক্ষাৎকার কক্ষের চেয়ারে বসে আছে। তার সামনে তিনজন টাকমাথার লোক। প্রশ্নকর্তাদের দেখে আনিসের কোনো দুশ্চিন্তা হচ্ছে না। এমন সময় একজন প্রশ্নকর্তা গম্ভীর মুখে প্রথম প্রশ্নটি করলেন—

‘আপনার নাম আনিস?’

‘জি।’

‘আচ্ছা, বাংলাদেশের মূল সমস্যা কোনটি বলে আপনার মনে হয়?’

‘একটি দেশে সাধারণত একটিই মূল সমস্যা থাকে। কিন্তু স্যার, বাংলাদেশের মূল সমস্যা কম করে হলেও এক ডজন।’

‘তাই নাকি! আপনাকে যদি শুধু একটি সমস্যার কথা জিজ্ঞেস করা হয়, তাহলে কোনটির কথা বলবেন?’

‘এই দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এই দেশে বড় বড় জায়গায় অযোগ্য লোক বসে আছেন এবং তাঁরা নিজেকে বিরাট জ্ঞানী ভাবছেন। তাঁদের মাথায় চুল কম। তাঁরা ভাবছেন নিজেরা জ্ঞানী বলেই তাঁদের চুল কম।’

‘কী!’

আনিসের উত্তর শুনে প্রথম প্রশ্নকর্তা হকচকিয়ে গেলেন। শুরুতেই তাঁর দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছে। চুলের বিষয়টি এনেছে। এই বিষয়ে কথা তার সহ্য হয় না। এই ছেলের সঙ্গে এভাবে হবে না। অন্যভাবে ফাঁদে ফেলতে হবে। তার কাছে মনে হচ্ছে তিনি নিজেই ফাঁদে পড়ে গেছেন।

এবার দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা গলাখাঁকারি দিলেন। তাঁর কাঁধে এখন আনিসকে ঘায়েল করার গুরুদায়িত্ব। দলের প্রথম উইকেট পড়ে গেছে বিনা রানে।

প্রশ্ন শুরু হলো:

‘আচ্ছা, আপনি টাকা এবং সততা—এই দুটোর মধ্যে কোনটা নেবেন?’

‘আমি স্যার টাকাই নেব।’

‘কেন? সততার কোনো গুরুত্ব নেই বলেই কি আপনার ধারণা?’

‘না স্যার। নিজের সততা বজায় রাখার জন্যই আমি টাকার কথাটা বললাম।’

‘বুঝিয়ে বলুন।’

‘আমি যদি বলতাম, আমি সততা নেব, তাহলে এটা মিথ্যা কথা হতো। এ জন্যই টাকার কথা বললাম। সত্যি কথা বলাও স্যার সততা। তাই আমি টাকার কথা বলে সততারই পক্ষ নিলাম।’

দ্বিতীয় প্রশ্নকর্তা খুক খুক করে আবারও কাশলেন। পরিস্থিতি এমন হবে, এটা তাঁর ধারণা ছিল না। তৃতীয় আরেকজন প্রশ্নকর্তা আছেন। তিনি কিছুই জিজ্ঞেস করছেন না। কিছুক্ষণ পরপর কান চুলকাচ্ছেন আর ভদ্র ভঙ্গিতে হাঁচি দিচ্ছেন।

আচমকা তৃতীয় প্রশ্নকর্তা বললেন, ‘আনিস সাহেব, আপনি যেতে পারেন। আপনি অতিরিক্ত চালাক। এত চালাক লোক নিয়ে কাজ করা যায় না। কাজ আদায় করার জন্য বোকা লোকের কোনো বিকল্প নেই।’

আনিস ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘আচ্ছা।’

আনিস বাইরে বের হয়ে এল। সে এখন আবার শাহবাগের রাস্তা দিয়ে হাঁটছে। ফুলের দোকানগুলোতে আজ ভীষণ ব্যস্ততা। আনিসের ফোন বেজে উঠল।

‘তোমার ইন্টারভিউ কেমন হলো?’

‘খুবই ভালো হয়েছে।’

‘এবারও চাকরি হয়নি, তাই না?’

‘হ্যাঁ। প্রশ্নকর্তারা আমাকে প্রশ্ন করে আটকাতে পারেনি। তাই চাকরি হয়নি।’

‘এখন কী করবে?’

‘তোমাকে নিয়ে ঘুরতে বের হব। মেঘময়ী পুষ্প বিতানের আশপাশে ঘুরব।’

‘এটা কিসের দোকান?’

‘ফুলের দোকান। সব ধরনের ফুল পাওয়া যায়।’

‘ফুলের দোকানে কেন?’

‘আজ বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ফুল হলো ভালোবাসার পবিত্রতম উপহার। তুমি তৈরি থেকো। আমি আসছি।’

‘আচ্ছা।’

লাইন কেটে গেল। মেঘবতীর মনে দারুণ আনন্দ হলো। সে জানে ‘মেঘময়ী পুষ্প বিতান’ নামে কোনো ফুলের দোকান নেই। আনিস তাকে খুব সুন্দর একটা ফুলের দোকানে নিয়ে যাবে। কিছু ফুল কিনে দেবে। তারপর বলবে, চাকরি হওয়ামাত্র এমন একটা দোকান সে নিজে দেবে। দোকানের নাম হবে ‘মেঘময়ী’। সেই দোকানের সবচেয়ে সুন্দর ফুলের নাম মেঘবতী।

আনিস প্রতিবার ইন্টারভিউ দেওয়ার পর এই পাগলামি করে। প্রিয় মানুষের সবকিছুই ভালো লাগে, পাগলামিও। আনিস মেঘবতীর প্রিয় মানুষ, এটা ভেবে তার লজ্জা লজ্জা লাগছে। আচ্ছা, মেয়েদের এত লজ্জা দিয়ে জগতে পাঠানো হলো কেন?

ঢাকা