মেঘনীল বেশে
সকাল থেকেই টিপটিপ বৃষ্টি। বাইরে বের হবেন বলে তৈরি হচ্ছেন, তখন আলমারি খুলে পোশাক বাছাই করতে গিয়ে নীল কোনো রঙের দিকেই কি হাতটা বাড়াতে মন চাইছে? বৃষ্টি দেখে কার না ইচ্ছে হয় গায়ে একটা নীল পোশাক জড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজার। এই সময় প্রকৃতিজুড়ে থাকে সবুজসহ নানা রঙের মেলা। তবে নীল রংটাকেই নিয়েই কেন এত মাতামাতি? কারণ নীলের সঙ্গে যে রয়েছে মেঘের সখ্য। যেন নীল আকাশটা গায়ে ছুঁয়ে দিলেই মেঘ ঝরে পড়বে বর্ষার বৃষ্টিরূপে।
নীপবনে বৃষ্টিতে ভেজার আমন্ত্রণ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, ‘দাও আকুলিয়া ঘন কালো কেশ, পরো দেহ ঘেরি মেঘনীল বেশ।’ তেমনটাই দেখা গিয়েছিল এই বছরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় বর্ষাবরণ উৎসবে। সেখানে নীল পোশাকে সেজে নাচ ও গানের মধ্য দিয়ে বর্ষাকে বরণ করে নেন সবাই। কথা হচ্ছিল এই অনুষ্ঠানের আয়োজক সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, বর্ষাবরণ অনুষ্ঠানের পোশাক হবে নীল, এটি অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। কবি-সাহিত্যিকেরা তাঁদের গল্প-কবিতা-উপন্যাসে বর্ষার রংকে নীল বলেই বর্ণনা করে গেছেন। বর্ষার পোশাকে নীল তুলে ধরার এটাও কারণ হতে পারে।
এদিকে চিত্রশিল্পী অশোক কর্মকারের কাছে মনে হয়, বর্ষা মানেই তো নীল আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টি। পানির যেহেতু কোনো নির্দিষ্ট রং নেই, তাই শিল্পী যখন তুলিতে তা ফুটিয়ে তোলেন, তখন সেটা নীল রঙেই প্রকাশ করা হয়। তেমনি নদী-নালা, খাল-বিল বর্ষার পানিতে ভরে উঠলে সেখানেও দেখা যায় নীলের প্রলেপ।
বর্ষার পোশাকে এত দিন মৌলিক নীল রঙের ব্যবহারটাই দেখা যেত। এখন নীলের নানা ধরন বা শেডে রাঙানো হয় পোশাক। দেশালের ডিজাইনার ইসরাত জাহান বললেন, এই রংগুলো বর্ষার প্রকৃতি থেকেই নেওয়া হয়। এই যেমন আকাশজুড়ে যখন ভারী মেঘ দেখা দেয় তখন আকাশ ধারণ করে ধূসর নীল রং। সন্ধ্যার আকাশে মেঘ সরে গেলে দেখা মেলে একটু গাঢ় নীলের। আর বর্ষায় আকাশের রংটাই তো আকাশনীল।
নীলের এমনই নানা রূপ পোশাকে তুলে ধরতে প্রকৃতি থেকে উপাদান নিয়ে থাকে ফ্যাশন হাউস অরণ্য। অরণ্যের সহকারী উৎপাদন ব্যবস্থাপক রিনা আক্তার জানালেন, কাপড়ে আকাশনীল রং ফুটিয়ে তুলতে চাইলে ইনডিগো বা নীল রঙে একবার ভিজিয়ে নিতে হবে। আরেকটু গাঢ় নীল আনতে চাইলে ভেজাতে হবে দুবার। তিনবার নীলের পানিতে ভেজালে রং হবে আরও গাঢ়। নীলে ধূসর আবহ আনতে মেশানো হয় হরীতকীর রং। এই হরীতকীর রং মেশানো নীলের সঙ্গে চুনের পানি মেশালে তৈরি হয় ময়ূরকণ্ঠী বা সবুজাভ রং।
রঙের মতো পোশাকের জমিনেও প্রকৃতিকে তুলে আনা হয়। সাধারণত টাই-ডাই আর হাতে আঁকা (হ্যান্ডপেইন্ট) নকশা বেশি দেখা যায়। টাই-ডাইয়ের মাধ্যমে একই পোশাকে নীলের অনেক শেড তুলে ধরা যায় বলে মনে করেন রঙ বাংলাদেশের ডিজাইনার সৌমিক দাস। অরণ্যের পোশাকেও এই ধারাটাই দেখা গেল। এদিকে শামুকের ডিজাইনার মনজুরুল আলম বললেন, বর্ষার প্রকৃতি অন্য রকম সজীব হয়ে ওঠে। পোশাকে হাতে এঁকে এর বহিঃপ্রকাশ সবচেয়ে ভালো হয়। ড্রেসিডেলের স্বত্বাধিকারী মায়া রহমানও জানালেন একই কথা। এখানেও দেখা গেল নয়নতারা, কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো হাতে আঁকা হয়েছে পোশাকে। যাত্রা ও কুমুদিনীতে পোশাকগুলোতে আবার ডাইয়ের মাধ্যমেই তুলে ধরা হয়েছে বর্ষার প্রকৃতির নানা রূপ।
কাপড়ের উপাদান হিসেবে এই মৌসুমে জর্জেট, এন্ডি সিল্ক বা মসলিন বেশ জনপ্রিয়। পাশাপাশি সুতির ওপর কাজ হচ্ছে। তবে যেহেতু একবার ভিজে গেলে শুকাতে অনেক সময় নেয়, তাই তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো। বর্ষাজুড়েই পোশাকের ক্যানভাসে নীল নিয়ে থাকবে এমনই নানা আয়োজন। কারণ, মেঘনীল বেশে সেজে বৃষ্টিবিলাসে মেতে ওঠার এই তো সময়।