মায়েরা জিতলে জিতব সবাই

বিপিএলের একটি ম্যাচে রাজশাহী কিংস দলের মিরাজ-মোস্তাফিজ-সৌম্যরা মাঠে নেমেছিলেন মায়ের নামের জার্সি পরে। ছবি: সংগৃহীত
বিপিএলের একটি ম্যাচে রাজশাহী কিংস দলের মিরাজ-মোস্তাফিজ-সৌম্যরা মাঠে নেমেছিলেন মায়ের নামের জার্সি পরে। ছবি: সংগৃহীত

১২ মে ‘মাদার্স ডে’, কিন্তু বাংলাদেশে অনেক আগেই ‘মা দিবস’ এসে গেছে। অন্ততপক্ষে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগ বিপিএলের দল রাজশাহী কিংসের খেলোয়াড়দের সৌজন্যে। রাজশাহী কিংসের খেলোয়াড়েরা ১৬ জানুয়ারি বিপিএলে ঢাকা ডায়নামাইটস দলের বিপক্ষে তাঁদের নির্ধারিত খেলায় নিজেদের নিয়মিত জার্সি না পরে নতুন জার্সি পরেছিলেন, তাতে যাঁর যাঁর নম্বরের নিচে লেখা ছিল মিরাজ-মোস্তাফিজ-সৌম্যদের মায়েদের নাম যেমন মিনারা, মাহমুদা, নমিতা ইত্যাদি।

রাজশাহী কিংস দলের প্রধান নির্বাহী তাহমিদ আজিজুল হক বলেছেন, আসলে তাঁর দল এই টুর্নামেন্টে একটি ম্যাচ খেলতে চেয়েছিল মায়েদের সম্মানে। মা-ই যে প্রতিটি সন্তানের কাছে সবচেয়ে বড় গর্ব আর প্রেরণার উৎসমুখ। মায়েদের জন্য খেলতে বিশেষ কোনো দিন লাগে না এবং মায়েরা অনিঃশেষ প্রেরণা জোগান বিজয়ী হতে।

এ ম্যাচে মিরাজ–মোস্তাফিজ–সৌম্যরা জিতেছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা ঢাকার বিপক্ষে। ২০১৬ সালের অক্টোবরে মহেন্দ্র সিং ধোনির ভারত মায়েদের নাম লেখা জার্সি পরে একটি ওয়ানডে ম্যাচে বিশাল ব্যবধানে হারিয়েছে নিউজিল্যান্ডকে। এই তো গত বছর মেসির বার্সেলোনা মায়েদের নাম লেখা জার্সি পরে হারিয়ে দিয়েছিল ভিয়া রিয়ালকে। মা যেমন সব সময়ই সন্তানকে বিজয়ী দেখতে চান, সন্তানও মাকে কখনো হারতে দিতে চান না।

অনুমান করতে পারি, কী বিপুল গর্ব নিয়ে মিরাজ–মোস্তাফিজদের মায়েরা সেদিনের খেলা দেখেছেন। হাজার হাজার দর্শক, টেলিভিশনের পর্দায় আরও লাখো-কোটি দর্শক শুধু তাঁদের নামটি দেখেননি, দেখেছেন নিজের জন্মদাগ বহনরত যুবকদের বিনীত গর্বের উচ্চারণ। ‘দেখ, আমি আজ নন্দিত খেলোয়াড়, তা সম্ভব হয়েছে শুধু আমার মায়ের জন্য।’

একদমই একটি প্রতীকী ব্যাপার, কিন্তু মিরাজ-মোস্তাফিজ-সৌম্যরা তাঁদের এই ব্যবহারের ভেতর দিয়ে অনেক বড় একটি বার্তা ছড়িয়ে দিলেন। মায়েদের সম্মান করলে আমরা নিজেরাই সম্মানিত হই। আরও একটি প্রচ্ছন্ন বার্তা ছিল তাঁদের সিদ্ধান্তে। সব সমাজের অগ্রগতির কেন্দ্রে রয়েছেন নারী, তাঁরা কখনো মা, কখনো ভগিনি। যে সমাজে নারীর মর্যাদা সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত, তারাই সবচেয়ে অগ্রসর। নারীর মর্যাদা মানে সংসারের ভেতরে ও বাইরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁরা কতটা সক্ষম। আর সে কথা মাপার সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি রয়েছে। যেমন শিক্ষার হার, কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁদের উপস্থিতি। এই মাপকাঠিগুলোর হিসাবে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে।

পিছিয়ে, কিন্তু তাকে বেশি দিন আর পিছিয়ে রাখা যাবে না। হাজার বছরের অবহেলা ও অমর্যাদা উপেক্ষা করে মেয়েরা অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের পেছনে ফেলে দিচ্ছে। দেশের অর্ধেকের বেশি জনসংখ্যা নারী। তাঁদের যদি অকেজো করে রাখা হয়, তাহলে দেশ তার অর্ধেক কর্মশক্তি থেকে বঞ্চিত হয়। গত দুই দশকে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশগ্রহণ নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বর্তমানে মোট কর্মক্ষম নারীর ৩৫ শতাংশ কোনো না কোনো ফলদায়ক কর্মক্ষেত্রে জড়িত। এই সংখ্যা একমাত্র নেপাল ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, চলতি ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী এক দশকে মোট কর্মক্ষম নারীর ৮০ শতাংশ নিয়মিত অথবা অনিয়মিত কর্মক্ষেত্রে অংশ নেবে।

শিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের অগ্রগতি তো আরও নাটকীয়। মোট সংখ্যার হিসাবে না হলেও আনুপাতিক হিসাবে মেয়েরা ছেলেদের পেছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার প্রতিটি ক্ষেত্রে। গত উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কথা ধরুন। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের পাসের হার ৬ শতাংশ বেশি। এই বছরে ছেলেদের পাসের হার ৬৩ দশমিক ৬৬ আর মেয়েদের ৬৯ দশমিক ৭।

মেয়েরা যে সত্যি এগিয়েছে, সে কথা বোঝার আরও উত্তম মাপকাঠি হলো তাদের আয়ুষ্কাল। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে পুরুষের তুলনায় মেয়েরা অধিক কাল বেঁচে থাকে। আশির দশকের গোড়ার দিকেও পৃথিবীর মাত্র তিনটি দেশে পুরুষের তুলনায় মেয়েদের আয়ুষ্কাল কম ছিল। বাংলাদেশ ছিল তার একটি। সে হিসাবও উল্টে গেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুসারে, এখন বাংলাদেশের পুরুষের আয়ু ৭১ দশমিক ১ বছর আর মেয়েদের ৭৪ দশমিক ৪ বছর। আইএলও জানিয়েছে, এত কম সময়ে ব্যবধান হ্রাসের এমন উদাহরণ আর নেই। ব্রাভো!

এ কথার অর্থ এই নয়, মেয়েদের সামনে কোনো বাধা নেই। যারা এত দিন ক্ষমতার ছড়ি ঘুরিয়েছে, তাদের হাতে সিদ্ধান্তের ভার থাকলে তারা যে ঘড়ির কাঁটা উল্টো দিকে ঘোরাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মেয়েদের স্বাধীনতার প্রশ্নে আমরা পুরুষেরা এখনো মাস্টারমশাই রয়ে গেছি। তারা কী পোশাক পরবে, কটা পর্যন্ত ঘরের বাইরে থাকতে পারবে, কী বিষয়ে লেখাপড়া করবে, চাকরি না বিয়ে—সবই আমরা পুরুষেরা ঠিক করে দিই। নিদেনপক্ষে সে চেষ্টা করি। সেটাই স্বাভাবিক। মেয়েরা যত মুক্ত হবে, আমাদের পুরুত ঠাকুরদের ক্ষমতার চাবির গোছা তত হালকা হবে।

তবে প্রকৃত ক্ষমতার হিসাবে মেয়েদের প্রভাব এখনো সীমিত। রাজনীতি বলুন বা ব্যবসা বলুন, নীতিনির্ধারণী অবস্থায় মেয়েদের সংখ্যা এখনো নগণ্য। বাংলাদেশের প্রধান কোনো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান নির্বাহী নারীর সংখ্যা দুই হাতের আঙুলে গোনা সম্ভব। রাজনীতিতে অবস্থা কিছুটা ভিন্ন, ২৫ বছর ধরেই দেশের প্রধানমন্ত্রী নারী। সদ্য অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ হাসিনা পরপর তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকের কাছে বলতে শুনেছি, এই সরকারে তিনি একাই পুরুষ, বাকি সবাই মিনমিনে ‘মেয়েমানুষ’। তা সত্ত্বেও মেয়েরা রাজনীতিতে নীতিনির্ধারণী ক্ষেত্রে পুরুষের সমান ভূমিকা পালন করছেন, এ কথা বলা যাবে না। সংসদে এখনো নারী সদস্যের সংখ্যা মাত্র ২০ শতাংশের মতো।

আমরা জানি, এ অবস্থা বদলের জন্য মেয়েরা লড়ছেন। সদ্যসমাপ্ত জাতীয় নির্বাচনে মোট ২২ জন নারী বিজয়ী হয়েছেন, যা আগের যেকোনো সংখ্যার চেয়ে বেশি। প্রার্থী হয়েছিলেন ৬৯ জন, যেটাও একটা রেকর্ড।

কোচ ল্যান্স ক্লুজনার (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজসহ রাজশাহী দলের সদস্যরা মায়ের নামে জার্সি হাতে
কোচ ল্যান্স ক্লুজনার (বাঁ থেকে দ্বিতীয়), অধিনায়ক মেহেদী হাসান মিরাজসহ রাজশাহী দলের সদস্যরা মায়ের নামে জার্সি হাতে

সত্যি সত্যি মেয়েরা কীভাবে এগোচ্ছে, তার এক চমৎকার গল্প পড়েছি লন্ডনের গার্ডিয়ান পত্রিকায়। বঙ্গোপসাগরের উপকূলের এক নারী, নাম রানী মণ্ডল। কয়েক বছর আগেও তিনি ছিলেন নিঃস্ব গৃহবধূ। চার বছর আগে মাত্র ১০ হাজার টাকার ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে তিনি চিংড়ি চাষের ব্যবসা শুরু করেন। এই চার বছরে সে টাকা তো তিনি ফেরত দিয়েছেনই, তার ওপর নিজের মোট পুঁজি দুই লাখ টাকায় নিয়ে গেছেন। গার্ডিয়ান–এর সাংবাদিককে রানী মণ্ডল বলেছেন, স্বামীর কাছে টাকাপয়সার জন্য এখন আর তাঁকে হাত পাততে হয় না। ‘এখন স্বামীর চেয়েও বেশি আয় করি আমি। আগে তেনার গলার আওয়াজ ছিল চড়া। এখন সেই তেজ কমে আসছে।’

খেলার মাঠটা অসমান, তারপরও মেয়েরা একের পর এক যুদ্ধে জিতে চলেছে। এই লড়াইটা আরও অনেক দূর এগিয়ে যায়, যদি আমরা পুরুষেরা মেয়েদের পাশে থাকি। মিরাজ-মোস্তাফিজ-সৌম্যরা তাঁদের মায়েদের যে সম্মান দেখিয়েছেন, এটাও এই লড়াইয়ের অংশ। তবে শুধু মায়েদের নয়, মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সত্যিকার বিজয় হবে সেদিন, যেদিন আমরা বুঝব মায়েরা জিতলে মেয়েরা জেতে, আর মেয়েরা যদি জেতে, তাহলে আমরা সবাই জিতব।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি