গ্লো অ্যান্ড লাভলী নিবেদিত গ্লোয়ের গল্প
মারজীয়ার উদ্যোগে নারীরা পেয়েছেন ভ্রমণের সুযোগ
নারী ভ্রমণপিপাসুদের সংস্থা লেডি ট্রাভেলারস বাংলাদেশ (এলটিবি)। যাঁরা হয়তো কখনো ঘুরে বেড়ানোর সাহস করে উঠতে পারেননি, এখন তাঁদের অনেকেই এলটিবির সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘোরার সুযোগ পাচ্ছেন। কর্মসংস্থানও হয়েছে কয়েকজন নারীর। লেডি ট্রাভেলারস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারজীয়া মেহজাবীনের কথা থাকছে এখানে।
ভ্রমণ পরিচালনাকারীদের দলে ভিড়ে মারজীয়া মেহজাবীন নিজেও ঘুরতে গিয়েছেন। অনেক সময় বন্ধুদের সঙ্গে বেরিয়েছেন রোমাঞ্চকর ভ্রমণে। বাস্তবতা তখনই দেখেছেন, নারীদের ভ্রমণের বাধাগুলো অনুভব করছেন একান্তভাবে। অনেক নারী হয়তো পুরুষের সঙ্গে ভ্রমণে অস্বস্তিবোধ করছেন, অনেকে আবার সন্তান সঙ্গে নিয়ে অন্যের বিরক্তির কারণ হচ্ছেন ভেবে আড়ষ্ট হয়ে থাকছেন, এমনও দেখেছেন অনেকে পাহাড়-পর্বতের চেয়ে কিছুটা আরামপ্রিয় ভ্রমণ পছন্দ করছেন। এসব কিছু নতুন করে বুঝলেন মারজীয়া মেহজাবীন নিজে মা হওয়ার পর। কোথাও ঘুরতে যাওয়ার আগে মনের ভেতর পেয়ে বসত চেনা অস্বস্তি, সঙ্গে ছোট শিশু অন্যের বিরক্তির কারণ হবে না তো!
অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকার মানুষ নন মারজীয়া মেহজাবীন। একসময় নিজেই উদ্যোগী হলেন। ফেসবুকে গ্রুপ খুললেন। দলে ভেড়ালেন সমমনা নারীদের। ভ্রমণ আয়োজনে বেড়াতে থাকলেন দেশে-বিদেশে। এভাবেই যাত্রা শুরু হলো ‘লেডি ট্রাভেলারস বাংলাদেশ (এলটিবি)’। যাঁরা হয়তো কখনো ঘুরে বেড়ানোর সাহস করে উঠতে পারেননি, এখন এমন অনেক নারীই এলটিবির সঙ্গে দেশে-বিদেশে ঘোরার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁরা ঘুরছেন বলেই ২০১৭ সালে চালু হওয়া এলটিবি ৪ বছরে ৩০০টি ট্যুর পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ৩০টি ট্যুর ছিল দেশের বাইরে। এর মধ্যে করোনা মহামারিও এসেছে। বিধিনিষেধের কারণে দীর্ঘদিন ট্যুর বন্ধ রাখতে হয়েছে।
লেডি ট্রাভেলারস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারজীয়া মেহজাবীন বলেন, ‘ভ্রমণ মনের প্রশান্তির জন্য ওষুধের মতো কাজ করে। আমাদের দেশের নারীদের ওপর যে ধকল যায়, তাতে তাঁদের বেরিয়ে পড়া আগে দরকার। স্বামীর ব্যস্ততার কারণে আমি নিজেও বেরিয়ে পড়তাম ঘুরতে। তখন মনে হলো অন্যদেরও উৎসাহিত করি, একসঙ্গে ঘুরি, সেই চিন্তা থেকেই ফেসবুকে গ্রুপটা খোলা।’
মনের প্রশান্তির ব্যাপারটি এই করোনাকালে নতুনভাবে আলোচিত হচ্ছে। মনের স্বাস্থ্যেরও যে পরিচর্যা দরকার, তা ঘুরেফিরে আসছে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মুখে। সেই মনের সুস্থতার অনুষঙ্গ হিসেবেই ২০১৭ সালের ৯ মে লেডি ট্রাভেলারস বাংলাদেশ (এলটিবি) গ্রুপ খোলা হয়। আগেই বলা হয়েছে, শুরুতে দল বেঁধে ঘুরতে যাওয়ার প্রয়াস ছিল সেটা। তবে মাস কয়েক পর, নারীদের বিপুল সাড়া পেয়ে মারজীয়া গ্রুপটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। বাণিজ্যিকভাবে ভ্রমণ শুরু করেন। তবে বাণিজ্যের চেয়ে ভ্রমণকারীরা বেশি পেয়েছে বন্ধুত্ব, সহযাত্রীসুলভ আচরণ। তাই তো দিন দিন গ্রুপে সদস্যসংখ্যা বাড়তে থাকল, বাড়তে থাকল আয়োজনের সংখ্যাও। এলটিবি এখন ৯৬ হাজারের বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীর পরিবার। গ্রুপের এই সদস্যরা নিজেরা ভ্রমণ নিয়ে কথা বলেন, ভ্রমণের ছবি দেন, লেখেন নিজেদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।
এলটিবির পরিধি বাড়ছে বলেই কয়েক মাস আগে রাজধানীর উত্তরায় কার্যালয় খোলা হয়েছে। সেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে ছয় নারীর। তাঁরা দাপ্তরিক কাজের পাশাপাশি নারীদের ভ্রমণে নিয়ে যান। মারজীয়া জানালেন, দেশের ভেতর সিলেট, কক্সবাজার, সেন্ট মার্টিন, সুন্দরবন, বান্দরবানসহ নানা পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ পরিচালনা করেছে এলটিবি। নারীদের দল বেঁধে নিয়ে গেছে সিঙ্গাপুর, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, মিসর, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশেও।
মারজীয়া মেহজাবীন বলেন, ‘আমরা অনেকেই সংসার আর পেশাজীবনের চক্করে পুরোনো বন্ধুদের হারিয়ে ফেলি। ছেলেরা কর্মক্ষেত্রে নতুন বন্ধু পেলেও নারীদের গণ্ডিটা সংকুচিত হয়ে যায়। ভ্রমণ তখন যেন স্বামীর দয়া অথবা পরিবারের অবসরের ওপর নির্ভর হয়ে ওঠে। এলটিবি এই নারীদের ভ্রমণের সুযোগ করে দিতে পারছে।’
ভ্রমণের মন কীভাবে গড়ে উঠেছে, তা মারজীয়া মেহজাবীনের নিজেও জানেন না। তবে উদ্যমী মনটা পেয়েছেন মা মাহমুদা খাতুনের কাছে। মাকে দেখেছেন একজন উদ্যমী মানুষ হিসেবে। মেয়ে মায়ের সেই একাগ্রতা পেয়েছেন সহজাতভাবেই।
মারজীয়া মেহজাবীনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা নারায়ণগঞ্জে। তিন বোনের মধ্যে তিনি বড়। সিদ্ধিরগঞ্জ রেবতী মোহন পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেছেন। রাজধানীর শান্ত–মারিয়াম ইউনিভার্সিটি থেকে ফ্যাশন ডিজাইনে স্নাতক হয়েছেন ২০১৫ সালে। এ র মধ্যে বিয়ে হয়ে যায়। তবে নিজে কিছু করার ইচ্ছা সব সময় অনুভব করেছেন। সেই কিছু করা যে নিজের আনন্দের বিষয় ভ্রমণ হবে, তা হয়তো নিজেও জানতেন না।
জানতেন না বলেই এলটিবি নিয়ে মারজীয়ার এখন নানা পরিকল্পনা। এই সংস্থার মাধ্যমে নারী ভ্রমণপিপাসুদের নিরাপদ ভ্রমণের সুযোগ তৈরিতে নিরন্তর চেষ্টা তাঁর। তাঁর সে চেষ্টায় আছে উদ্যম, একাগ্রতা আর নিষ্ঠা। সাফল্যের জন্য আর কী–ই বা লাগে!