মূল রচনা
ভালো কাজের ‘হোটেল’
মানুষকে ভালো কাজে উৎসাহ জোগাতে রাজধানীর একদল তরুণ খুলে বসেছেন ‘হোটেল’—ভালো কাজের হোটেল। অসহায় মানুষেরা যেখানে একটি ভালো কাজের কথা বলে একবেলা খাবার খেতে পারেন।
ব্যতিব্যস্ত বয়–বেয়ারার দেখা নেই, ক্যাশ কাউন্টারের হাঁকডাক কিংবা বেলের ক্রিং ক্রিংও নেই, নেই সুসজ্জিত টেবিলে খাওয়ার ধুম। হোটেল বলতে যে পাঁচমিশালি কথার হট্টগোল, সেসবের বালাইও নেই সেখানে। বলতেই পারেন, এ কেমন হোটেল রে বাপু!
এ হোটেল ‘ভালো কাজের হোটেল’। স্রেফ ফুটপাতঘেঁষা সফেদ দেয়াল, যেখানে লাল হরফে বড় করে লেখা—ভালো কাজের হোটেল। আরও আছে হোটেলসম্পর্কিত তথ্য। রাজধানীর কমলাপুর আইসিডি কাস্টম হাউস পেরিয়ে কয়েক কদম এগোতেই দৃষ্টি কাড়ে ব্যতিক্রমী হোটেলের জায়গাটি।
২ সেপ্টেম্বর দুপুরে গিয়েছিলাম সেখানে। সময় হতেই ‘হোটেলে’ আসতে শুরু করলেন অতিথিরা, যাঁদের কেউ এলেন গুটি গুটি পায়ে, কেউবা খুঁড়িয়ে। কেউ এলেন হেলেদুলে। কারও গতি ত্রস্ত। নানা ভঙ্গিতে আসা মানুষেরা বসলেন এই সময়ের সামাজিক দূরত্ব মেনে। একজনের পর আরেকজন। ফুটপাতে দীর্ঘ সারি। অপেক্ষমাণ লোকজন তখন ক্ষণ গুনতে থাকলেন খাবার হাতে পাওয়ার।
ভাদ্র মাসের গনগনে সূর্য নিজেকে উজাড় করছে যেন। তবে ফুটপাতে ছায়া ফেলেছে সড়কে অবসরযাপনে থাকা সারি সারি বিআরটিসির বাস। কাছাকাছি বাসের ডিপো বলেই সড়কের অর্ধেকটা নিয়ে বাসগুলো রাখা। মানুষজনের আনাগোনা কম বলে ফুটপাতে প্রায় নির্জনতা।
বেলা দেড়টা বাজতেই ব্যাটারিচালিত একটি ভ্যান পৌঁছাল। এলেন জনা কয়েক স্বেচ্ছাসেবকও। নড়েচড়ে বসলেন অপেক্ষমাণ অতিথিরা। স্বেচ্ছাসেবকেরা ভ্যান থেকে খাবারের প্যাকেট তুলে নিলেন। এক তরুণকে দেখা গেল জরিপকারীর ভূমিকায়। তিনি ক্লিপবোর্ড হাতে অপেক্ষমাণ অতিথিদের জিজ্ঞেস করতে থাকলেন দুটি প্রশ্ন—‘আপনার নাম?’, ‘আজ আপনি কী ভালো কাজ করেছেন?’
একজন জানালেন অন্ধজনকে রাস্তা পারাপারে সহায়তার কথা। কারও মুখে নিঃস্ব মানুষকে বিনা পয়সায় গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার প্রশান্তি। কেউবা বললেন কোনো ভালো কাজই করেননি তিনি। স্বেচ্ছাসেবী তরুণ উত্তর লিখে রাখলেন খাতায়। তারপরই তুলে দেওয়া হলো খাবারের প্যাকেট। মানুষদের মনোযোগ তখন প্যাকেটের ডিম-খিচুড়িতে।
তাঁরা এলেন ভালো কাজের খবর নিয়ে
আগত অতিথিদের বেশভূষা কিছুটা জানান দিচ্ছিল তাঁদের সম্পর্কে। কথা বলে জানা গেল, কেউ কমলাপুর রেলস্টেশনের কুলি। আছেন রিকশাচালক। অসহায় পথচারী আর ভবঘুরে কেউ কেউ। তাঁদেরই একজন রিকশাচালক শহীদুল ইসলাম। যাত্রী এনেছিলেন কমলাপুরে। গন্তব্যে নামিয়ে যাচ্ছিলেন মুগদার দিকে। পথেই দেখেন খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসে জানলেন শর্তের কথা। সে শর্ত তিনি সকালেই পূরণ করেছেন। আগ্রহ নিয়ে জানালেন, এক যাত্রীকে কীভাবে বিনা ভাড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন গন্তব্যে। খাবারের প্যাকেট পেতেই শহীদুলের মুখে তৃপ্তির হাসি।
দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায় এসেছেন সবুজ আলী। ২৬ বছরের এই তরুণ কাজ করেন কারওয়ান বাজারে। টুকরি মাথায় মিন্তির কাজ করতে গিয়ে ঘাড়ে ব্যথা পেয়েছেন। দিন কয়েক হলো কাজ করতে পারছেন না। অভিমান করে ঘর ছেড়েছেন বলে বাড়িতে ফিরতেও পারছেন না। কয়েক দিন কাজ করে সঞ্চয় যা ছিল, তা–ও ফুরিয়ে গেছে। ফুটপাতে থাকার বন্দোবস্ত, কিন্তু তিন বেলা খাবার নিয়ে যত দুশ্চিন্তা তাঁর। তিন দিন ধরে দুপুরে খাচ্ছেন ভালো কাজের হোটেলে। সবুজ একজন দৃষ্টিহীন মানুষকে রাস্তা পার করতে সহায়তা করেছেন। এটি তাঁর দিনের ভালো কাজ।
হোটেল–বৃত্তান্ত
রাজধানীর একদল তরুণ ভালো কাজকে উৎসাহিত করতে খুলে বসেছেন ব্যতিক্রমী হোটেলটি। শনি থেকে বৃহস্পতিবার অসহায় মানুষকে অন্তত একটি ভালো কাজের বিনিময়ে খাবার দেন। শনিবারে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত চলে এ কার্যক্রমন। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে বেলা দেড়টা থেকে তিনটা পর্যন্ত। শুক্রবার তাঁরা খাবার নিয়ে ছোটেন রাজধানীর বিভিন্ন মসজিদ ও এতিমখানায়। মসজিদের সামনে আসা নিম্ন আয়ের মানুষদের হাতে যেমন খাবার তুলে দেন, তেমনি এতিমখানায় গিয়ে এতিমদের খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দেন। এভাবে ২০০ থেকে ২৫০ জনকে খাওয়ান। সপ্তাহখানেক আগে শুরু হয়েছে হোটেলের কার্যক্রম। তবে উদ্যোগের শুরুটা গত ডিসেম্বরে, ‘ভালো কাজের বিনিময়ে আহার’ নামে যার শুরু হয়েছিল। সে উদ্যোগের মাধ্যমে সপ্তাহের কোনো একদিন ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে খাওয়াতেন তরুণ এই স্বেচ্ছাকর্মীরা, করোনাকালে কর্মহীন মানুষদের কষ্ট দেখে যা হয়ে ওঠে নিয়মিত। সেই ধারাবাহিকতায় শুরু হয় ভালো কাজের হোটেল।
এই স্বেচ্ছাসেবকেরা ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামের ফেসবুকভিত্তিক একটি সামাজিক উদ্যোগে যুক্ত। স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান আরিফুর রহমান। তরুণ এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘অসহায়, নিরন্ন মানুষদের জন্যই আমাদের এই প্রচেষ্টা। সেই সঙ্গে আমরা চাই ভালো কাজকে উৎসাহ দিতে, পথের এই মানুষেরাও যেন ভালো কাজ করেন।’
ইয়ুথ ফর বাংলাদেশের শুরুর দিকের একজন শিহানুর রহমান। পেশায় স্থপতি শিহানুর ফুরসত পেলেই ছুটে আসেন খাবার বিতরণে। তিনি বলছিলেন, ‘আমরা এই কার্যক্রম পরিচালনা করি “ডেইলি টেন মেম্বার”–এর মাধ্যমে।’
‘ডেইলি টেন মেম্বার’! খটকা লাগতেই বুঝিয়ে দিলেন শিহানুর। রোজ যারা সংগঠনের তহবিলে ১০ টাকা করে জমা দেন, তাঁরাই এই বিশেষ সদস্য। তাঁদের সংগঠনের ফেসবুক গ্রুপে কয়েক হাজার মানুষ যুক্ত থাকলেও রোজ ১০ টাকা দেন, এমন সদস্য আছেন ২৬৫ জন, যাঁদের সহায়তায় পরিচালিত হয় ‘ভালো কাজের বিনিময়ে আহার’।
ব্যয়ের হিসাবও জানালেন আরিফুর রহমান, চাঁদা থেকে মাসিক প্রায় ৮০ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। সে টাকায় ১২ কি ১৩ দিন খাওয়াতে পারেন তাঁরা। আবার সদস্যদের অনেকেই উদ্যোগী হয়ে খাবারের ব্যবস্থা করেন। সব মিলে ২০ দিনের মতো অসহায় মানুষদের খাবার সরবরাহ করতে পারেন। এ মাস থেকে চেষ্টা করছেন পুরো মাস খাওয়ানোর।
ভালো কাজের শুরু
কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছিল অসহায়দের পাশে দাঁড়ানো এক ব্যক্তির গল্প। সে অনুপ্রেরণায় মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করে তরুণদল, ২০০৯ সালে যার শুরু। আরিফুর রহমান, আশিকুর রহমান, তামিম চৌধুরী, রাজীব সরকার, মো. মাহবুব, মো. সোহেল, মো. ফয়সালরা সেই সংকল্প এখনো লালন করেন। আরিফুর রহমান বলেন, ‘সে সময় আমরা এক অসহায় বাবার পাশে দাঁড়িয়েছিলাম। মেয়ের চিকিৎসা করাতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকার জন্য পথে পথে ঘুরছিলেন তিনি।’
এরপর কমলাপুর রেলস্টেশনের ছিন্নমূল শিশুদের পড়ানোর ব্যবস্থা করেন এই তরুণেরা। পথের শিশুদের স্কুলমুখী করতে ব্যবস্থা নেন খাবারের। সে–ও নিজেদের টাকায়। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়েছেন আরিফুর রহমানেরা। পেশাগত জীবনে একে একে ব্যস্ত হয়েছেন। কিন্তু ভালো কাজের প্রয়াসটা অটুট রয়ে গেছে।
২০১২ সালে সাংগঠনিক রূপ দিতে ফেসবুকে শুরু করেন ‘ইয়ুথ ফর বাংলাদেশ’ নামের প্ল্যাটফর্ম। গ্রুপে যুক্ত হয়েছেন শাহিনুর রহমান, শাওন রহমান, মনিরুজ্জামানের মতো স্বেচ্ছাসেবকেরা। তাঁরাই এগিয়ে নিচ্ছেন কার্যক্রম। বন্যার্তদের পাশে ত্রাণ নিয়ে ছুটে যাওয়া, অসহায়দের জন্য চিকিৎসাসেবা, শীতার্তদের শীতবস্ত্র বিতরণসহ নানা সামাজিক কাজে যুক্ত আছেন এই তরুণেরা।