বৈদ্যুতিক বিমান নির্মাণে দেবযানী
‘আজ জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন, এত দিন টিভিতে, মুভিতে নাসার কন্ট্রোল রুম টাইপ যে সিচুয়েশন দেখতাম, আজ নিজেই সে রকম একটা ‘ফিউচারিস্টিক’ ক্ষণে অংশ নিলাম। সম্ভবত আমিই একমাত্র নন-ইউরোপিয়ান হিসেবে আমন্ত্রিত ছিলাম, তবে এটা গর্বের বিষয় না, আসল গর্ব যখন বারবার বলছিলাম, আই অ্যাম ফ্রম বাংলাদেশ...’।
২৯ সেপ্টেম্বর নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এই স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন বাংলাদেশি গবেষক দেবযানী ঘোষ। দিনটি যে শুধু দেবযানীর জন্য স্মরণীয়, তা নয়। বিশ্বের বেসামরিক বিমান চলাচল ইতিহাসেই এটি স্মরণীয় দিন। জার্মানির স্টুটগার্ট বিমানবন্দরে এইচওয়াই-৪ নামের একটি চার আসনের যাত্রীবাহী বিমানের সফল উড়াল সম্পন্ন হয় সেদিন। নতুন একটি উড়োজাহাজের উড্ডয়ন অবতরণ নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু এই ঘটনা ইতিহাস এ কারণে যে, এইচওয়াই-৪ হচ্ছে পৃথিবীর প্রথম কার্বন নিঃসরণমুক্ত বিমান। যেটি চলে জ্বালানি কোষ ও ব্যাটারির সাহায্যে। এই বিমানের শব্দও কম।
এইচওয়াই-৪-এর উড়াল দেখতে জার্মানির গণমাধ্যম, বিজ্ঞানী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের ট্রান্সপোর্ট কমিশনার, গবেষণা অংশীদারেরা উপস্থিত ছিলেন বিমানবন্দরে। দেবযানী ঘোষ সেখানে দর্শক হিসেবে ছিলেন না, ছিলেন এই বিমান তৈরির একজন ‘কারিগর’ হিসেবেই। এই বিমান প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক নেতৃত্বে আছে জার্মান অ্যারোস্পেস সেন্টার (ডিএলআর)। প্রধান গবেষণা অংশীদার ইউনিভার্সিটি অব উলম। ইউনিভার্সিটি অব উলমের গবেষণা দলে পিএইচডি গবেষক হিসেবে কাজ করছেন চট্টগ্রামের মেয়ে দেবযানী ঘোষ। দলনেতা ড. জোসেফ কাল্লোসহ এ দলে সদস্যসংখ্যা তিন। বিমান নির্মাণের অংশীদার হিসেবে আছে পিপিস্ট্রেল, এইচটুফ্লাই, হাইড্রোজেনিক্স।
বিমানটির একজন গবেষক হিসেবে সারাক্ষণ একটা উত্তেজনা কাজ করছিল দেবযানীর মনে—সবকিছু সফলভাবে সম্পন্ন হবে তো? ই-মেইল যোগাযোগে দেবযানী বলেন, ‘বিমান উড়তে পারবে কি না, উড়তে পারলেও মাঝ-আকাশে কোনো ঝামেলা হয় কি না, নিরাপদে অবতরণ করে কি না—এসব নিয়ে টেনশন ছিল আমার মধ্যে। তবে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই সফলভাবে হয়। উপস্থিত সাংবাদিক এবং অন্য বিজ্ঞানীদের সব প্রশ্নের উত্তর ও কৌতূহল মেটাতে এইচওয়াই-৪ দল বেশ সফলই ছিল।’
এইচওয়াই-৪ বিমানের ব্যাপারটা একটু বোঝা যাক। গ্রিনহাউস ইফেক্ট কমানোর কথা এলে শুধু প্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাদ দিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে বিদ্যুৎ তৈরির কথা ভাবা হয়। কিংবা বিদ্যুচ্চালিত মোটরগাড়ি নামানোর কথা বলা হয়। কিন্তু অনেকেই জানেন না, বিমান গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের অন্যতম প্রধান উৎস।
দেবযানী বলেন, ‘সাধারণত উড়োজাহাজে জ্বালানি হিসেবে আভগ্যাস, জেট ফুয়েল ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। এগুলো থেকে গ্রিনহাউস গ্যাস, বিশেষ করে ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়। দিনকে দিন বিমানের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। আর সেই সঙ্গে বাড়ছে কার্বন নিঃসরণ। এইচওয়াই-৪ বিমানের ভাবনা এখান থেকেই। চেষ্টা ছিল এমন উড়োজাহাজ তৈরি করার, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সাহায্য করবে।’
এইচওয়াই-৪ হাইব্রিড বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ। জ্বালানি কোষ (ফুয়েল সেল) ও ব্যাটারি এই বিমানের প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে। ফুয়েল সেল সরাসরি হাইড্রোজেন এবং বাতাসের অক্সিজেন থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। বৈদ্যুতিক মোটরের সাহায্যে এই বিদ্যুৎ দিয়ে বিমান চলে। দেবযানী বললেন, ‘এই প্রক্রিয়ায় বর্জ্য হিসেবে উৎপন্ন হয় শুধু পানি। উচ্চক্ষমতার লিথিয়াম ব্যাটারি বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণের জন্য বাড়তি শক্তি সরবরাহ করে।’
এইচওয়াই-৪ বিমানের বিদ্যুৎশক্তির ব্যবস্থাপনা নিয়েই কাজ দেবযানীর। তিনি বলেন, ‘ফুয়েল সেল এবং ব্যাটারির ডিসি বিদ্যুৎকে এসিতে রূপান্তর করার জন্য একটা সম্পূর্ণ নতুন সিলিকন কার্বাইডের পাওয়ার ইলেকট্রনিকস আর্কিটেকচার তৈরি করা হলো আমার কাজ।’ আর এটা এমনভাবে বানাতে হবে, যা একই সঙ্গে ভালো কাজ দেবে, ওজনে হালকা ও বিশ্বস্ত হবে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন যন্ত্রাংশ এবং পাওয়ার ইলেকট্রনিকসের মধ্যে একটা ইন্টারফেস তৈরি করেন দেবযানী। এটি বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রণ কৌশল এবং ব্যাটারির চার্জিং-ডিসচার্জিং অনুযায়ী শক্তির প্রবাহ বদলে দিতে পারে।
শুরু থেকেই দেবযানীর ইচ্ছা ছিল পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি এবং নবায়নযোগ্য শক্তি নিয়ে কাজ করার। আরডব্লিউটিএইচ আখেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে যখন গবেষণার বিষয় খুঁজছিলেন দেবযানী, তখন এইচওয়াই-৪-এর ব্যাপারে জানতে পারেন। ‘আমি এই প্রকল্পের প্রধান গবেষক ড. জোসেফ কাল্লোর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কয়েক ধাপে সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর আমাকে নির্বাচন করেন। আমি তাঁর সঙ্গে এই প্রকল্পে কাজ করার সুযোগ পাই।’
দেবযানীর বাবা দীপক কুমার ঘোষ এবং মা ইন্দিরা ঘোষ দুজনই দীর্ঘদিন শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৮৮ সালে ৩০ অক্টোবর জন্ম দেবযানীর। দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। ছোট বোন দেবশ্রী ঘোষ চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন। দেবযানী চট্টগ্রাম পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বেরিয়ে ভর্তি হন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তড়িৎ ও ইলেকট্রনিকস প্রকৌশলে স্নাতক হওয়ার পর দেবযানী কিছুদিন শিক্ষকতা করেন চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটিতে। এরপর চলে যান জার্মানি। এখন পিএইচডি করছেন ইউনিভার্সিটি অব উলমে।
তরুণ এই বিজ্ঞানী একটি ওয়েব পোর্টালও চালান। ‘জার্মান প্রবাসে’ নামের পোর্টালটির প্রধান সম্পাদক তিনি। জানালেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে দেশের একটি যোগসূত্র তৈরি করা হয় এতে। জার্মান প্রবাসের ফেসবুক পেজে লাইকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। এটি এ বছর ডয়চে ভেলের দ্য ববস পুরস্কার পেয়েছে।
বই পড়তে ভালোবাসেন দেবযানী। তাঁর ভালো লাগে ছবি আঁকতেও। ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক বিমান নিয়েই কাজ করে যেতে চান। বললেন, ‘এইচওয়াই-৪ বিমানের প্রযুক্তিকে আরও উন্নত করতে চাই, যাতে বড় আকারের বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী বিমান চালাতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। আর আমাদের পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব হয়।’
দেবযানী চান বাংলাদেশের মেয়েরা বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দুনিয়ায় আরও বেশি করে পদচারণ করুক। ‘ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। নিজের সক্ষমতা বা অক্ষমতার দায় নিজেকে নিতে শিখতে হবে। পৃথিবীর কোনো সিস্টেমই পারফেক্ট না। কিন্তু এখান থেকেই সবাই উঠে আসে, উঠে আসতে হয়। প্রতিকূলতার মোকাবিলা করে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এগোলে পৃথিবীর সবখানেই কাজ করা যায়।’ এমনটাই বিশ্বাস এই বাংলাদেশি গবেষকের।