বিয়ের আগে এই ব্যাপারে আগ্রহী নই

অধ্যাপক মেহতাব খানম
অধ্যাপক মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

আমার বয়স ২২ বছর। স্নাতক (সম্মান) তৃতীয় বর্ষে পড়ি। এক ছেলের সঙ্গে প্রায় পাঁচ বছরের প্রেমের সম্পর্ক। আমরা সমবয়সী। আমরা দুজন দুজনকে সত্যি অনেক ভালোবাসি, শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস করি। আগে সে দুই-তিনবার শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ইচ্ছা জানালেও আমার অসম্মতি থাকায় বিষয়টা মেনে নিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক মাস থেকে এ ব্যাপারে আমাকে জোর করছিল, তার অনেক সমস্যা হচ্ছে এই বিষয়েও জানিয়েছে। অনেক অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু বিয়ের আগে আমি এ ব্যাপারে আগ্রহী নই। এখন তাকে কীভাবে সাহায্য করব, তা-ও বুঝে উঠতে পারছি না। বিষয়টি নিয়ে আমাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউ কাউকে হারাতে চাই না। আমার কী করা উচিত?

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ

তোমরা সতেরো বছর বয়স থেকে পরস্পরের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কে রয়েছ। বেশ দীর্ঘ একটি পথ পাড়ি দিয়েছ বলা যেতে পারে। খুব ভালো লাগল জেনে যে তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ছাড়াও শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রয়েছে। ছেলেটি আগে শারীরিক সম্পর্কে যাওয়ার ব্যাপারে তোমার অনিচ্ছাকে শ্রদ্ধা দেখালেও বর্তমানে আর সেটি রক্ষা করতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে তার সহিষ্ণুতার জায়গাটি চর্চা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, এ ক্ষেত্রে আজন্মলালিত মূল্যবোধ, বিশ্বাস, রুচিবোধ, মনোভাব তোমাকে বিয়ের আগে এ ধরনের সম্পর্কে যেতে বাধা দিচ্ছে। এ ছাড়া ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণও এটিকে সমর্থন করে না। তোমার প্রতি আমি সম্মান জানাচ্ছি এত দীর্ঘ সময়ের পারস্পরিক সম্পর্কে তুমি সংযমী আচরণ করেছ এবং ছেলেটিকেও অসম্মতি জানিয়ে বিরত রেখেছ।

দুঃখজনক হচ্ছে, এই বিষয়ে পরিবার ও সমাজ ছেলে এবং মেয়েদের ভিন্ন বার্তা দিয়ে বড় করে। মেয়েদের জন্য অনেক বেশি অনুশাসন ও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, কিন্তু ছেলেদের এ বিষয়ের প্রতি আগ্রহকে শিথিলভাবে দেখা হয়। ছেলেরা অনেক অল্প বয়স থেকেই সেক্স নিয়ে ফ্যান্টাসি করে, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এবং নানা উৎস থেকে বিষয়টি বোঝার জন্য প্রয়াস চালায়। এখন প্রযুক্তির কল্যাণে অল্পবয়সী ছেলেরাও পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

ভালোবাসার সম্পর্কে শারীরিক ও মানসিক দুটো দিকই রয়েছে। বয়ঃসন্ধিতে ও প্রাপ্তবয়সে নারী-পুরুষ যখন বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি আকর্ষিত হয়, তখন তার মধ্যে শরীরের চেয়ে মনের ক্ষুধাই বেশি তীব্র থাকে। শরীরের পরিবর্তন এই আকর্ষণটি সৃষ্টি করলেও মানুষ আসলে মানসিক ও আবেগীয় নিরাপত্তাই খুঁজতে থাকে প্রতিনিয়ত। মনোবিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন যে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ তার কাছেই আশ্রয় চায় যে তাকে বোঝে, বিশ্বাস করে এবং নিরাপদ বোধ করতে সহায়তা করে। শৈশবে আমাদের প্রাথমিক যত্নকারীর সঙ্গে যদি দৃঢ় একটি আবেগীয় বন্ধন তৈরি হয় তাহলে পরবর্তী জীবনে কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয় থেকে আমরা সহজেই মুক্ত থাকতে পারি।

ছেলেটি এখন তোমার ওপর জোর করে নিজের ইচ্ছা চাপিয়ে দিচ্ছে। এর ফলে তুমি তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে রয়েছ। আবার ছেলেটিও কি তোমাকে হারিয়ে ফেলবে মনে করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তার ভেতরের নিরাপত্তাহীনতাকে লাঘব করতে চাইছে? আমাদের সমাজে মেয়েরা সাধারণত মনে করে যার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে তাকে অবশ্যই পরে বিয়ে করতে হবে, কারণ সে তার সবকিছুই দিয়ে দিয়েছে। ছেলেটি কী শুধু এই বিশেষ সম্পর্কটি চাইছে, নাকি সে সব সময় তোমাকে নিজের সঙ্গে রাখতে পারবে এই নিশ্চয়তা চাইছে, সেটি বোঝা দরকার।

যেহেতু সে তোমার সমবয়সী, হয়তো বা তার মনে হতে পারে তোমার বিয়ে হয়ে যেতে পারে এবং তাকে উপযুক্ত হতে গেলে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে। ওর সঙ্গে কথা বলে বোঝার চেষ্টা করো সে কী মানসিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে নাকি শুধু শারীরিক চাহিদার কারণে এতটা অস্থির হয়ে পড়েছে। যদি তার মানসিক কারণ হয়ে থাকে, তাহলে তুমি ওকে পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করো যে পরিবার থেকে যদি তোমাকে বিয়ের জন্য চাপও দেওয়া হয়, তারপরও তুমি ছেলেটি উপযুক্ত হওয়া পর্যন্ত অবশ্যই অপেক্ষা করবে। আর যদি শারীরিক চাহিদা হয়ে থাকে, তাহলে ওকে বলো যে সে দীর্ঘ পাঁচ বছর তোমার ইচ্ছার প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এটাই প্রমাণ করে তার যথেষ্ট আত্মসংযম রয়েছে। তুমি আশা করবে সে বিয়ের আগপর্যন্ত এই চারিত্রিক দৃঢ়তা দেখাতে সক্ষম হবে এবং তুমি তার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।