বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন বিষয়ে পড়বেন?
কদিন পরই শুরু হচ্ছে ‘ভর্তিযুদ্ধ’। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন লাখো শিক্ষার্থী। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে কীভাবে বিষয় বাছাই করা উচিত, বলেছেন গবেষক, শিক্ষক ও পেশাজীবীরা।
সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তি নিয়ে কাজের অনেক সুযোগ তৈরি হবে
ড. নাদিম চৌধুরী, সেমিকন্ডাক্টর গবেষক, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যুক্তরাষ্ট্র
শুধু যে দেশের অবস্থা বিবেচনা করে বিষয় পছন্দ করবেন, বিষয়টি এমন নয়। দেশের বাইরেও এখন পেশা গড়ার সুযোগ আছে। প্রযুক্তি খাতনির্ভর অনেক পেশায় কাজের সুযোগ বাড়ছে। আপনি প্রকৌশল বা প্রযুক্তিতে না পড়েও এই শিল্পে কাজ করতে পারেন। বিবিএ পড়ে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতে পারেন। আবার কোডিং বা প্রোগ্রামিং শিখে যেকোনো সাধারণ বিষয়ে পড়েও আপনি নামী প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পারেন।
আমি মনে করি, সেমিকন্ডাক্টর প্রযুক্তিসংক্রান্ত কাজের বড় সুযোগ সামনে তৈরি হচ্ছে। কেননা আমাদের সরকার বৈশ্বিক সেমিকন্ডাক্টরের বাজারে প্রবেশ করার কথা ভাবছে। সে জন্য প্রচুর দক্ষ লোক প্রয়োজন হবে। শুধু যে তড়িৎ প্রকৌশলীই দরকার হবে, তা নয়; যন্ত্রকৌশল, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ফলিত পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, এসব বিষয়েও দক্ষ মানুষ প্রয়োজন। এ ছাড়া মেকাট্রনিকস, মেশিন লার্নিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা; অর্থাৎ অটোমেশনসংক্রান্ত পড়ালেখা ভবিষ্যতে কাজে আসবে।
কেউ যদি চারুকলা বা সামাজিক বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ে পড়েন, তাহলে অ্যাপ ডিজাইন, সামাজিক গবেষণাসহ বিভিন্ন বিশ্লেষণনির্ভর পেশায় যুক্ত হতে পারেন। যে বিষয়েই পড়েন না কেন, বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা কতটা বাড়ছে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পছন্দের বিষয়সংক্রান্ত গবেষণা ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কতটা আছে, জানার চেষ্টা করুন। পাশাপাশি মানবিক দক্ষতা বিকাশের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
পছন্দের বিষয় নিয়ে একরোখা না হয়ে নমনীয় থাকুন
খালেদ মাহমুদ, সহযোগী অধ্যাপক, ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
আমাদের দেশের বাস্তবতায় অনেকেই পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পাবেন না। অনেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো না কোনো বিষয়ে ভর্তি হয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে থাকবেন।
যাঁরা নিজের আগ্রহের বিষয়ে পড়বেন, তাঁরা যেন নিজের আগ্রহকে আরও শাণিত করতে পারেন, সে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে। আবার যাঁরা পছন্দের বিষয় পড়ার সুযোগ পাবেন না, তাঁদেরও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। ভালো লাগার বিষয়ে পড়তে না পারলেও ভবিষ্যতে মনের মতো কাজ করার অনেক সুযোগ আসবে। কম্পিউটারবিজ্ঞান যাঁর ভালো লাগে, তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত নিয়ে পড়ালেখা করেও তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন। পাশাপাশি কম্পিউটার নিয়ে কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ তো থাকবেই। কাজের অভিজ্ঞতা যদি হয়, ভবিষ্যতে তিনি কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর বা পিএইচডিও করতে পারেন। আবার নিজের প্রতিষ্ঠান বা উদ্যোগ গড়ে তোলারও সুযোগ আছে।
সব সময় হাতে কয়েকটি সুযোগ রাখুন। নিজের ভালো লাগার বিষয় নিয়ে একরোখা না হয়ে নমনীয় থাকুন। যে সুযোগ আসবে, তা নিয়েই পড়ুন। পড়ার বিষয় যা-ই হোক, প্রশিক্ষণ নিয়ে আপনি ভবিষ্যতের পেশাজীবী হিসেবে নিজেকে তৈরি করতে পারেন। আবার ধরুন যাঁরা লেখক বা কবি হতে চান, পছন্দের বিষয়ে পড়তে না পারলেও কিন্তু তাঁদের সুযোগ নষ্ট হবে না। যাঁরা অ্যানিমেটর হতে চান, হয়তো পড়বেন বিবিএতে, তাঁদেরও এখন দেশে বসেই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ আছে। বাংলায় পড়েও কিন্তু ভবিষ্যতে আপনি ব্যাংকে চাকরি করতে পারেন। মূল কথা হচ্ছে, এখন আর আগের মতো বিষয়কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনার সুযোগ নেই। বিশ্বায়নের কারণে দেশে বসেই যেমন বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ বাড়ছে, তেমনি নিজের বিষয়ের বাইরেও অনেক বিষয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে।
অ্যাকাউন্টিং, ফাইন্যান্স—এসব বিষয়ের চাহিদা সব সময় থাকবে। কিন্তু এগুলোর সঙ্গে তথ্য বিশ্লেষণ (ডেটা অ্যানালিটিকস), ডেটা সায়েন্স ইত্যাদি বিষয় যুক্ত হবে। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে গার্মেন্টস, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সংস্থায় নতুন নতুন কাজের সুযোগ আসবে।
হুজুগে বিষয় বাছাই করে ভবিষ্যতে টেকা যাবে না
ফাহিম মাশরুর, প্রতিষ্ঠাতা, বিডিজবস
এক দশক আগের চাকরির বাজার আর এখনকার বাজার এক নয়। এখন সুযোগ ও প্রতিযোগিতা দুই-ই বেশি। সরকারি-বেসরকারি চাকরির সুযোগ যেমন বাড়ছে, তেমনি নানা উদ্যোগের বিকাশ ঘটছে। এখন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শুরু করবেন, তাঁদের জন্য সামনে অনেক রকম সুযোগ আসবে। তাই বলে হুজুগে বিষয় বাছাই করে টেকা যাবে না। সবাই বিবিএ পড়ছে বলেই আমিও পড়ব, এমন ধারণা থেকে না পড়া ভালো।
যাঁরা মানবিক বা সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে পড়বেন, তাঁদের মাথায় রাখা দরকার, দক্ষতানির্ভর বিভিন্ন বিষয় আপনাদের শুরু থেকে শিখতে হবে। পড়ালেখার বিষয় বা পছন্দের পেশা যা-ই হোক; কম্পিউটার দক্ষতা, ইংরেজি বলা ও লেখার দক্ষতা আপনার প্রয়োজন হবে।
একইভাবে বিবিএ বা প্রকৌশলের মতো বিষয়ে পড়ার কথা যাঁরা ভাবছেন, তাঁদেরও মাথায় রাখতে হবে, বিষয়নির্ভর জ্ঞানের পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়েও আপনার ধারণা রাখা জরুরি। যেহেতু কর্মবাজারে এখন সৃজনশীলতাকে বিশেষ যোগ্যতা হিসেবে ধরা হচ্ছে, তাই সৃজনশীল ও স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে আপনাকে যুক্ত হতে হবে। কম্পিউটার প্রকৌশল, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের মতো টেকনিক্যাল বিষয়গুলোর চাহিদা বাড়বে।
যে বিষয়ে পড়তে চান, বর্তমানে সেই কেন্দ্রিক কাজের সুযোগ কেমন, সে সম্পর্কে খোঁজ নিন। কাজের সঙ্গে আধুনিকায়ন বা অটোমেশনের বিষয়গুলো জড়িত কি না, তা-ও জানা জরুরি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কথা ভাবছেন, সেখানকার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে কোথায় কী কাজ করছেন, জানার চেষ্টা করুন। বিবিএপড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থী এখন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। নতুন উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত হন। সর্বোপরি জানার ও কাজের পরিধি এখন আগের চেয়ে অনেক বড়। এটি মাথায় রেখেই বিষয় নির্বাচন করুন।