বাসা থেকে তুলেছি ৫০ প্রজাতির পাখির ছবি

ডালিমগাছে বেগুনি মৌটুসি

আমি যে বাসায় থাকি, সেটি রংপুর শহরের উপকণ্ঠে পার্কমোড় এলাকায়। এ বাসার পাশেই আছে খোকসা ঘাঘট নদ। এ নদের ডান তীরে আমার বাসা, বাঁ তীরেই আছে তিনটি গাছ। এখানে নদীর স্রোত কিছুটা উল্টো দিকে পশ্চিম-উত্তরে প্রবাহিত। বাসার ঠিক পূর্ব দিকে আছে একটি আম ও একটি ডুমুরগাছ। এ ছাড়া বাসার পূর্ব ও উত্তর দিকে কয়েকটি অন্যান্য গাছও আছে। এই নদী এবং গাছে বসা পাখির ছবিই আমি তুলেছি।

তিলা ঘুঘু
ছবি: লেখক

বাসার ছাদে টবে আছে একটি ডালিমগাছ। এই গাছে ফুল আসার সঙ্গে সঙ্গেই বেগুনি মৌটুসি পাখি আসতে থাকে। আমি মধু সংগ্রহ করতে থাকা মৌটুসির ছবি তুলেছি। ছাদে কবুতর আছে। কবুতরের খাবার দিলেই সেখানে চড়ুই ও ভাতশালিক চলে আসে। অনেক কাছে থেকেই এসব পাখির ছবি পেয়েছি। নদী এবং বাসার অপর দিকে একটি রেস্তোরাঁ আছে। করোনাকালে অনেক দিন বন্ধ ছিল। সেখানে ডাহুক এসে বাসা বেঁধেছিল। নদীর পাড় ধরে এক জোড়া ডাহুক হেঁটে বেড়াত। কখনো কখনো একটানা দীর্ঘ সময় ধরে ডাকত। বাসা থেকে এসব দেখতাম। ডাহুকের উড়ন্ত ছবিও পেয়েছি।

ডাহুক

কখনো কখনো ডাহুকের বাচ্চাও চোখে পড়ে। শীত মৌসুমে নদীর পাড়ে সারা দিন কানিবক দেখা যায়। কখনো কখনো সাদা বকও আসে। হলুদ বেনেবউ পেয়েছি দারুণভাবে। নীলগলা বসন্তবাউরি ও ছোট বসন্তবাউরিও পেয়েছি বাসার উল্টো দিকের গাছে। ডুমুর যখন পাকে, তখন এরা ফল খেত। বাসার চারদিকেই পেলাম ঘুঘু, হাঁড়িচাঁচা। বাংলা বুলবুলি, সিপাহি বুলবুলিও সব সময় আসে।

ধলাবুক মাছরাঙা

নদীর ধারে এসে পড়ে দুই ধরনের খঞ্জনা এবং ছোট চাপাখি। পানিতে পড়ে পানকৌড়ি। পানকৌড়ি ডুব দিয়েই শিং মাছ ধরার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছিল মাছ ধরা কত সহজ। তিন ধরনের মাছরাঙারও মাছ ধরার দৃশ্য দেখতে পেয়েছি। মেঘ হও মাছরাঙা দেখতে বেশ বড়। কয়েক দিন ছোট আকারের টাকি মাছ ধরতে দেখেছি। সাদাগলা মাছরাঙা বাচ্চা দিয়েছিল এ নদীর পাড়েই। বাচ্চাগুলো একটু বড় হওয়ার পর চারটি মাছরাঙাকে সারা দিন উড়তে দেখেছি। মাছ ধরে বাচ্চাদের খাওয়ানোর দৃশ্যও দারুণ। পাতি মাছরাঙাও নদীতে মাছ শিকারে পটু।

বুলবুলি

কাঠঠোকরা, পাকড়া কাঠঠোকরা, বাংলা কাঠঠোকরা নামের তিন ধরনের কাঠঠোকরা সব সময়ই দেখা যায়। ছাদে ও বারান্দায় বসে টুনটুনি, বাবুইয়ের ছবি তোলা সহজ। ছাদ থেকে সামান্য দূরের গাছে টিয়া পাখি দেখা যায়। বাসার পাশে একটি নারকেলগাছ গর্ত করে ঝুঁটি শালিক বাসা বেঁধেছিল। এর পাশেই গোশালিক বাসা করেছিল সুপারিগাছে। গোশালিক সারা দিন ধরে বাচ্চাদের খাওয়াত। কাঠশালিক কখনো একাই, কখনো দল বেঁধে আসে। দোয়েল পাখিও খাবার সংগ্রহ করত। ছাদ থেকে দূরবর্তী টাওয়ারে বসে থাকা এবং আকাশে উড়তে থাকা চিলের ছবিও পেয়েছি। লালঘাড় শাহীন পাখির ছবি ঘরে বসেই তোলার সৌভাগ্য হয়েছে। অনেক দূরে ১০ তলা ভবনের ওপরের একটি টাওয়ারে বসে ছিল। যদিও ছবি খুব পরিষ্কার পাইনি। বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত শিকার ধরা পাখি লালঘাড় শাহীন।

হুদহুদ

নদীর পাড়েই পেয়েছি হুদহুদ পাখি। একটি ধানখেতে প্রায়ই আসে দুই ধরনের মুনিয়া। ধূসর মৌটুসি বাসার বারান্দায় ঝোলানো দড়ির আঁশ তুলে নিয়ে যেত বাসা বানানোর জন্য। ফটিকজল, কাঠশালিক ও বনচড়ুই কখনো কখনো দীর্ঘ সময় ধরে দেখা যায়। সাত ভাই সাঁতারে পাখি আসে দল বেঁধে।

কালাপাশ চুটকি ও তাইগা নামের দুটি ছোট পাখি কিছুদিন ছোট ছোট পোকা ধরার জন্য সারাক্ষণ ওড়াউড়ি করত। ফিঙে, কসাই, লাটোরা, দুই ধরনের কোকিল, ছোট সাহেলি, ধলাগলা লেজনাচানি, চোখ গেল, বাদুড় পাখিও প্রায়ই দেখা যায়।

কানিবক

একেক দিন উড়ন্ত মাছরাঙার ছবি তোলার জন্য তিন-চার ঘণ্টা বসে ছিলাম। এক ছোঁ দিয়ে দুটি মাছ শিকারের বিরল ছবি পেয়েছি। বকের বিচিত্র ভঙ্গির ছবির জন্যও অনেক সময় ক্যামেরা তাক করে থাকতে হয়েছে। কচুরিপানায় আসত লাল বক। যদিও এই লাল বকের ছবি বাসা থেকে তুলতে পারিনি। একেকটি ভালো ছবি তোলার একেক আনন্দ। এভাবে ছবি তুলতে তুলতেই বাসা থেকে প্রায় অর্ধশত প্রজাতির পাখির ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে।

(উপরে বাঁ থেকে) পানকৌড়ি ও সাদা-ভ্রু খঞ্জন। (মাঝে) হাঁড়িচাঁচা ও ফিঙে। (নিচে) ঝুঁটি শালিক ও টুনটুনি।

দেশে করোনা সংক্রমণ শুরুর সময় যাদের মনে হতাশা দানা বেঁধেছিল, আমি তাদের বাইরে নই। গত বছর ১৭ মার্চ যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিল, তখন থেকে ভীতিও ক্রমে সংক্রমিত হতে শুরু করল। এরপর যখন সরকারি ছুটি ঘোষণা হলো, তখন ভীতি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শুরুতে যে পরিমাণ নিষ্ঠুর আচরণ শুরু হয়েছিল, তাতে করে মানসিকতা বিক্ষিপ্ত না হওয়ার কারণ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমজুড়ে ছিল শুধু দীর্ঘশ্বাস।

নদী পাড়ের এই বাড়ি থেকেই ছবিগুলো তোলা হয়েছে

তখন আমি বাসায় বসেই শুরু করি ছবি তোলা। কখনো পড়ন্ত বিকেলের ছবি, কখনো চাঁদের ছবি, কখনো পাখির ছবি। ফেসবুকে পোস্ট করার পর মনে হলো চারদিক অন্ধকার করে তোলা করোনাকালে ছবিগুলো মানুষের সামান্য হলেও ভালো লেগেছে। আমি তখন বিশেষত পাখির ছবি তোলায় মনোযোগ বাড়িয়ে দিই। কখনো বিছানাঘর, কখনো বারান্দা, কখনো ছাদে গিয়ে পাখির ছবি তুলতে থাকি। এভাবে পাখির ছবি তুলতে তুলতে সেটি এখন বিশেষ শখে পরিণত হয়েছে।

লেখক: বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক
ই–মেইল: [email protected]