বাবা, তুমি কেমন আছ?
২০ জুন বাবা দিবস। করোনাকালে অনেকেই তাঁদের বাবাকে হারিয়েছেন। সাধারণ থেকে বিখ্যাত সব বাবাই সন্তানদের হৃদয়ে বিশেষ জায়গায় থাকেন। ব্যস্ত ও খ্যাতিমান বাবা সন্তানের কাছে কেমন ছিলেন? করোনাকালে হারিয়ে যাওয়া তেমন এক বাবা কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর সন্তান
বাবা, তুমি কেমন আছ? এক মাস হতে চলল, তোমার সঙ্গে দেখা হয় না। মুঠোফোনটা বেজে উঠলেই মনে হয়, তুমি কল করেছ, কানে দিলেই যেন তোমার গলার স্বর শুনতে পাব। স্পিড ডায়ালের প্রথম নম্বরটা এখনো তোমার নামে। বোতাম চাপলেই যেন তোমার কাছে কল চলে যাবে একলহমায়। কত কথা যে বলা বাকি।
বাবা, তোমার মনে পড়ে সেই লাল খেলনা গাড়িটার কথা? একদিন সকালে ঘুম থেকে জেগে দেখি, আমাদের তিন ভাই–বোনের জন্য খেলনা কিনে এনেছ তুমি। সেগুলো হাতে পেয়ে আমাদের সেকি আনন্দ। কিংবা সেই ছড়া আর গল্পের বইগুলোর কথা? তোমার হাত ধরে বইমেলায় গিয়ে ব্যাগ ভর্তি করে যেগুলো কিনেছিলাম। বই কিনে দিতে কার্পণ্য করতে তোমায় দেখিনি কখনো।
তোমার স্টাডির দেয়াল জোড়া তাকভর্তি বইয়ের মাঝেই তো শৈশবের স্বপ্নরাজ্যের খোঁজ পেয়েছিলাম। দেখা দিয়েছিল ফেলুদা, উরাশিমা তারো, সিভকা-বুর্কা, পারস্যের জাদুকর, সুন্দরবনের ডোরাকাটা বাঘ, চিতল হরিণ, এলাটিং–বেলাটিং, আফ্রিকার পিগমি, বুশম্যান, বান্টু—আরও কত কে?
গরম দিনের ঘুমজড়ানো কত দুপুর যে কেটেছে গাদাগাদি করে রাখা পুরোনো বইয়ের হলদে হয়ে যাওয়া পাতার ঘ্রাণ নিয়ে। ডিলান থমাস, গ্যেটে, কাফকা, সার্ত্র, নিৎশে, হেমিংওয়ে—নামগুলো বড্ড খটমটে লাগত তখন। গীতা, রামায়ণ, মহাভারত, বাইবেল প্রথম দেখেছি ওই বইয়ের তাকেই। মুর্তজা বশীর, হাশেম খান, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, আবুল বারক আলভী, প্রাণেশ কুমার মণ্ডলের মতো নামজাদা শিল্পীদের আঁকা ছবির সঙ্গে প্রথম পরিচয় ও পরিণয় তোমার স্টাডিতেই। বড় হয়েও তোমার কাছ থেকে ধার করে কত বই যে পড়েছি, তার ইয়ত্তা নেই। এখনো কত বই পড়ে আছে ঘরে, পড়ে আর ফেরত দেওয়া হয়নি।
বাবা, তোমার মনে পড়ে রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখার কথা? ম্যারাডোনাকে সেই যে প্রথম দেখেছিলাম, ঝাঁকড়া চুলের ছোটখাটো লোকটা বল পায়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা মাঠ। তুমি কিন্তু কোনো দিনই খোলাসা করে বলোনি, আসলে কোন দল তোমার প্রিয়। কখনো বলেছ ইতালি, কখনো জার্মানি, কখনোবা ব্রাজিল। আমার পড়ার ঘরে তখন টাঙানো থাকত ম্যারাডোনা, বেবেতো, ব্যাজিওর রংচঙা ছবি। ফাঁকে–ফোকরে দেখা দিত শচীন-আজহার। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচ হলে তুমি বরাবরই ভারতের পক্ষে। পাকিস্তানের পক্ষে কেন নয় জানতে চাইলে জবাব দিয়েছ, ওদের সঙ্গে তো আমরা যুদ্ধ করেছি। খেলায় আবার এসব কেন—প্রশ্নের উত্তরে বলেছ, খেলা কি জীবনের অংশ নয়? লেখাপড়া নিয়ে মায়ের কাছে অনেক বকুনি খেলেও তোমার প্রশ্রয় ছিল অবারিত। স্থাপত্য নিয়ে পড়ালেখা করার আগ্রহ জন্মেছিল তোমার উৎসাহেই।
বাবা, তোমার মনে পড়ে সেই ঈদের কথা? যেবার তোমার হাত ধরে হাটে গিয়ে অনেক খুঁজেও মনমতো একটা ছাগল না পেয়ে ঘরে ফিরেছিলাম সন্ধ্যায়। ঈদের দিন ভোরবেলায় ঘুম ভেঙে বারান্দায় গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা ছাগল বাঁধা। তুমি ঠিকই রাত করে আবার হাটে গিয়ে অনেক খুঁজে ছাগলটা নিয়ে এলে আমরা ভাই–বোনেরা ঘুমিয়ে গেলে। সেই ছাগল দেখে আমাদের খুশি দেখে কে!
বাবা, তুমি কি জানো কর্মসূত্রে তুমি যখন দিনের পর দিন বিদেশে ছিলে, তোমার একটা চিঠি বা টেলিফোনের জন্য কীভাবে মুখিয়ে থাকতাম? বিদেশ থেকে তোমার দেওয়া চিঠির খাম, ডাকটিকিট, তোমার আনা খেলনাগুলো এখনো দেরাজবন্দী। বহু দেশ, বহু পথ ঘুরে দেখার সুযোগ তোমার হয়েছে। নিজের দেশ, নিজের মাটির টান তোমার কাছে ছিল সবচেয়ে বড়।
তুমি যেবার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পেলে, গর্বে আমার ছোট বুকটা ফুলে এই এত্ত বড় হয়েছিল। তোমার পাওয়া কতশত পুরস্কারে ঘর ভরে গেছে। একুশে পদক পেয়ে সেটি উৎসর্গ করলে তোমার পরম স্নেহের নাতনিকে। নাতি-নাতনিদের চাঁদের হাটে তোমার আনন্দোচ্ছল হাসিমুখটা আর দেখি না যে বাবা। তোমাকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি কেবল দুবার। একবার তোমার পিতাকে হারাবার শোকে, আরেকবার পৌত্রকে হারাবার বেদনায়।
বাবা, তোমার স্নেহ ছিল বটবৃক্ষের দীর্ঘ শীতল ছায়ার মতো। জীবনের বন্ধুর পথে চলতে গিয়ে যখনই হাঁপিয়ে গেছি, হোঁচট খেয়েছি, শান্ত শীতল সে ছায়ায় বসে দুদণ্ড জিরিয়ে নিয়েছি। রোদে-জলে তোমার ছায়া ছিল ভরসার আশ্রয়স্থল। সততা, কর্মনিষ্ঠা, অসাম্প্রদায়িকতা, দায়িত্বশীলতা, ন্যায়বোধের প্রতীক রূপে তোমাকে দেখেই বড় হয়েছি। আজ তোমার ছায়া পাই না যে বাবা, মাথার ওপরে গনগনে সূর্য। তোমার পড়ার টেবিল, চশমা, বইপত্তর, লেখার খাতা, কলম, পদক, পুরস্কার—সব পড়ে আছে তোমার অপেক্ষায়। তোমার নোনা জলে বুনো সংসার আজ খাঁ খাঁ করছে যে। হাওয়া কলে জোড়া গাড়ি থমকে পড়ে আছে সিংহদরজার মুখে৷ মধ্যরাতে গ্লাস আর দুলে ওঠে না। মোমশিল্পের বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়ে গেল। সারিবদ্ধ জ্যোৎস্নায় কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদে মুখোমুখি আর কেউ বসে নেই। স্বপ্নহীনতার পক্ষে আর কেউ বলবার নেই—দাও বৃক্ষ দাও দিন।
বাবা, তুমি কেমন আছ?
কত কথা যে বলা বাকি।
লেখক: সদ্য প্রয়াত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ছেলে।