২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাংলাদেশের ক্রিকেটবন্ধু

>
রবিন মারলার যখন তরুণ। ছবি: সংগৃহীত
রবিন মারলার যখন তরুণ। ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটিশ ক্রিকেটার ও ক্রীড়া সাংবাদিক রবিন মারলার। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নামও যখন অনেকে জানেন না, সে সময় তিনি আঁচ করেছিলেন বাংলাদেশে ক্রিকেটের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। সানডে টাইমস পত্রিকায় আগ্রহ নিয়ে লিখেছিলেন ‘উইদার বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন। ১৯৭৬ সালে প্রকাশিত সেই যুগান্তকারী প্রতিবেদন বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ আয়োজনে ভূমিকা রেখেছিল। সহজ করেছিল আইসিসির সদস্য পদ পাওয়ার পথ। রবিন মারলারকে নিয়ে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন।

সাউদাম্পটনের হ্যাম্পশায়ার বোলে গত রোববার দুপুরে বাংলাদেশ দলের অনুশীলন মাত্রই শেষ হয়েছে। হঠাৎ কী মনে করে মুঠোফোনের কন্টাক্ট লিস্ট থেকে তাঁর নম্বরটা বের করে আরেকবার কল দেওয়া হলো। অনেকভাবেই তো চেষ্টা হলো, আরেকটিবার আঁধার হাতড়ে দেখাই যাক—যদি পাওয়া যায়। টুত…টুত…ফোন বাজছে! রিসিভারটা তিনিই ওঠাবেন তো?

ইংলিশ সাংবাদিকদের কাছ থেকেই জেনেছি, তিনি মোবাইল, ই-মেইল কিছুই ব্যবহার করেন না। সেখানে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, ফেসবুক, টুইটার আবার কী! তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম সাসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব আর একটা ল্যান্ডফোন নম্বর। নানা চেষ্টাচরিত করে এই নম্বরটা পাওয়া গেছে সানডে টাইমস–এর সহকারী ক্রীড়া সম্পাদক গ্রেগ স্ট্রাথার্সের কাছ থেকে। যোগাযোগের উপায় খুঁজতে সানডে টাইমস বরাবর ই-মেইল করা হয়েছিল। সৌজন্য দেখিয়ে সে বার্তার উত্তরে গ্রেগ একটা নম্বর দিয়েছিলেন, তবে নিশ্চয়তা দিতে পারেননি আদৌ এই নম্বরে কাঙ্ক্ষিত মানুষটির সঙ্গে কথা বলা যাবে কি না।

এ এক লম্বা যাত্রা—যে যাত্রার শুরুটা গত বছরের জানুয়ারি থেকে। দেশ-বিদেশের পরিচিত-অপরিচিত ক্রীড়া সাংবাদিক, লেখক, সংগঠকের কাছে পাওয়া ছোট-বড় নানা তথ্য-উপাত্ত জোড়া লাগিয়ে রহস্য উপন্যাসের মতো অবশেষে ধাঁধার উত্তর মেলানো গেল সোমবার, যখন কানে ভেসে এল—‘ইয়েস, আই অ্যাম রবিন মারলার।’ অনেক চেষ্টার পর যেন ঝিনুক থেকে মুক্তার সন্ধান মিলল! একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চ আর ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে পড়ল মনে—অবশেষে রবিন মারলারকে পাওয়া গেল!

গত বছর বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়কদের নিয়ে একটা গবেষণাধর্মী কাজ করতে গিয়ে রবিন মারলার নামটার সঙ্গে খুব ভালোভাবে পরিচয়। বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ যে শক্ত অবস্থানে দাঁড়িয়ে, ৪৩ বছর আগে সেটির ভিত গড়া হয়েছিল যে কজন মানুষের হাতে, সেখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল এই ব্রিটিশ ভদ্রলোক, কেমব্রিজ ব্লু পাওয়া, সাবেক সাসেক্স অধিনায়ক রবিন মারলার—যাঁর খেলোয়াড়ি জীবন যেমন সমৃদ্ধ, খেলা ছাড়ার পর প্রখ্যাত হয়েছেন ক্রিকেট লিখিয়ে হিসেবে। সাফল্য আছে সংগঠক হিসেবেও।

বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরুর আগে রাজশাহীতে এমসিসি ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দল, ১৯৭৬। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরুর আগে রাজশাহীতে এমসিসি ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল দল, ১৯৭৬। ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশিদের ক্রিকেটপ্রীতি জানল বিশ্ব

বাংলাদেশ ক্রিকেটে মারলারের অবদান কী, সেটি জানতে ফিরে যেতে হবে চার দশক আগে। স্বাধীনতার পরের বছর, ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড (পরে অবশ্য ‘কন্ট্রোল’ শব্দটা ছেঁটে ফেলা হয়েছে)। একই বছরে ঘরোয়া ক্রিকেট শুরু হলেও সেটিতে গতি আসতে সময় লাগে আরও কয়েক বছর। সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশের ক্রিকেট অবকাঠামো সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। নিজের মতো করে চালিয়ে নেওয়া ঘরোয়া ক্রিকেটকে অবলম্বন করে ধীর পায়ে এগোচ্ছিল বাংলাদেশ। একেবারেই দৃষ্টির আড়ালে থাকা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে যিনি প্রথম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচয় করিয়ে দিলেন—রবিন মারলার। ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রিটিশ দৈনিক দ্য সানডে টাইমস–এ মারলার একটি প্রতিবেদন লিখলেন ‘বাংলাদেশ কোথায়’ শিরোনামে।

এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে বিশ্ব ক্রিকেট প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট সম্পর্কে বিশদ ধারণা পেল। ১৯৭৫-৭৬ ঘরোয়া ক্রিকেটের মৌসুম শেষে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কনফারেন্সের (এখনকার ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি) কাছে আবেদন করল সহযোগী সদস্য পদের জন্য। ১৯৭৬ সালের জুনে আইসিসির সভায় উঠল বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়ার বিষয়টি। আইসিসি বিসিসিবিকে পরামর্শ দিল মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবকে (এমসিসি) আমন্ত্রণ জানাতে। এমসিসির ট্যুর রিপোর্টের ওপর নির্ভর করবে আইসিসির সিদ্ধান্ত। বিসিসিবি আমন্ত্রণ জানাল এমসিসিকে।

রবিন মারলার এখন
রবিন মারলার এখন

বিসিসিবির ধারাবাহিক যোগাযোগে এমসিসি বাংলাদেশে এল ১৯৭৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর। বিসিসিবি দলকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করল। ১৫ দিনের সফরে আসা এমসিসি শুরুতে দুই দিনের দুটি ম্যাচ খেলল উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলের বিপক্ষে। ১৯৭৭ সালের ৭, ৮ ও ৯ জানুয়ারি ঢাকা স্টেডিয়ামে (এখনকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) বিসিসিবির যে দলটি এমসিসির বিপক্ষে তিন দিনের ম্যাচ খেলল, এ ম্যাচটিই বাংলাদেশ দলের প্রথম ম্যাচ। তখনকার পত্রপত্রিকায় লেখা হলো, বাংলাদেশের প্রথম ‘আনঅফিশিয়াল টেস্ট ম্যাচ’। বাংলাদেশ ক্রিকেট আজ এ পর্যায়ে আসতে এমসিসির কাছে যেমন অনেক ঋণ, ঋণ আছে মারলারের কাছেও।

নিজের শক্তিশালী কলমকে কাজে লাগিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে তুলে ধরাই শুধু নয়, এমসিসিকে বাংলাদেশ সফরে রাজি করাতেও মারলারের অবদান কম নয়। সত্তর দশকের সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে কদিন আগে একটা বই লিখেছেন ২৮৯ প্রথম শ্রেণি ক্রিকেটে ৯৭০ উইকেট পাওয়া এই অফ স্পিনার। মারলার বইটার শিরোনাম দিয়েছেন গোল্ডেন মিনোজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড কাপ ২০১৯: আফগানিস্তান অ্যান্ড বাংলাদেশ হিট দ্য বিগ টাইম। বইটার প্রথম অর্ধেক বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস নিয়ে, বাকিটা আফগানদের উত্থানের গল্প। মাত্র ৫০০ কপি ছাপা হওয়া দুর্লভ বইটার সন্ধান পাওয়া গেল ট্রেন্ট ব্রিজ গ্রন্থাগারে। বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ কাভার করতে গিয়ে ট্রেন্ট ব্রিজের গ্রন্থাগারিক ওয়েইন থমাসের কাছে মিলেছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এই বইয়ের সন্ধান।

বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁর ভালোবাসার সম্পর্ক

অনেক চেষ্টা করে গত রোববার যখন ফোনে পাওয়া গেল মারলারকে, শুরুতেই তিনি বললেন, ‘তুমি আমার বইটা যদি পারো সংগ্রহ করে নিয়ো। সাসেক্স কাউন্টি ক্রিকেট ক্লাব মিউজিয়াম অ্যান্ড এডুকেশন ট্রাস্ট থেকে এটা বের করা হয়েছে। যা জানতে চাইছ, ওখানে সব উত্তর পেয়ে যাবে।’

বইয়ে পাওয়া যাবে, কিন্তু আপনার মুখ থেকে যে সরাসরি শুনতে চাই। এত দিন ধরে আপনাকে খোঁজ করছি, একটু কথা না বললে যে এ চেষ্টার পূর্ণতা পায় না—বলতেই খুব খুশি হলেন মারলার, ‘সমস্যা নেই। আমার বয়স ৮৯ চলছে। সৌভাগ্যবান যে এখনো বেঁচে আছি! তোমার হাতে কলম বা পেনসিল আছে? আমি বলে যাচ্ছি, নোট নাও।’

ফোনের ও প্রান্ত থেকে ভেসে আসা খুক খুক কাশি বলে দিচ্ছে, শরীর খুব একটা ভালো নেই মারলারের। তবুও আনন্দ নিয়ে এক নিশ্বাসে বলে গেলেন সত্তর দশকে সেই ঢাকা সফরের অভিজ্ঞতা, ‘তখন বাংলাদেশ নিয়ে কেউ আগ্রহী ছিল না। কিন্তু আমি ভীষণ আগ্রহী হয়ে উঠলাম। কেন? আমি একজন সাংবাদিক। সানডে টাইমস–এর হয়ে কাজ করতাম। স্বাধীনতার কিছু পর গিয়েছিলাম ঢাকায়, ব্রিটিশ ক্রিকেট অঙ্গনের আমি একমাত্র ব্যক্তি, যে আগ্রহী হয়েছিলাম বাংলাদেশে যেতে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের তেমন কোনো অবকাঠামো ছিল না তখন। তবে ক্রিকেটে জড়িয়ে থাকা মানুষদের কাছে যে অভ্যর্থনা পেয়েছিলাম, সেটি অবিশ্বাস্য! ওয়ান্ডারফুল, টেরিফিক! অনেক ভালোবাসা পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে আমার তো সম্পর্ক ভালোবাসারই। লেখার রসদ খুঁজতে তখনকার ক্রীড়ামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত লিখেছি আমার নতুন বইয়ে।’

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস উঠে এসেছে রবিন মারলারের এই বইটিতে
বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস উঠে এসেছে রবিন মারলারের এই বইটিতে

ঢাকা থেকে ফেরার পর বাংলাদেশ ক্রিকেট নিয়ে যখন মারলার তাঁর সহকর্মী কিংবা এমসিসিকে বললেন, দৃশ্যে খুব একটা বদল এল না। কেউ খুব একটা আগ্রহই দেখাল না। জীবনের গোধূলিতে দাঁড়ানো মারলার স্মৃতির আলমারি থেকে বের করলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটকে সহায়তা করার সে অভিজ্ঞতা, ‘যখন লন্ডনে ফিরলাম, তখন কেউ এটা নিয়ে আগ্রহী নয়। যাকেই বলি শুধু বলে নো, নো, নো! বাংলাদেশ খুব করে চাইছিল এমসিসি যেন সফরটা করে। আমি লিখেছিলাম, বাংলাদেশের ক্রিকেটকে অবজ্ঞা করা যাবে না। বাংলাদেশের ক্রিকেট–সম্ভাবনা উপেক্ষা করা যাবে না। এমসিসিকে আনতে তখন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের রাইস খান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। আচ্ছা, তিনি কি বেঁচে আছেন?’

মারলারকে একটু সংশোধনী দিতে হলো, রাইস খান নয়; রইসউদ্দিন আহমেদ, বিসিসিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক। ‘তাই নাকি! আমি তাহলে বইয়ে তাঁর নামটা ভুল লিখেছি, এটার সংশোধনী দিতে হবে। যা হোক, মাসের পর মাস অপেক্ষা শেষে এমসিসি শেষ পর্যন্ত রাজি হলো বাংলাদেশে যেতে। পরে তো আরও চারবার এমসিসি বাংলাদেশ সফরে গেল।’

মারলার পরে এমসিসির সঙ্গেও ঢাকা সফরে এসেছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে এসেছিলেন ২০০০ সালে বাংলাদেশের টেস্ট অভিষেকের সেই আনন্দক্ষণেও। তাঁর বইয়ে বাংলাদেশকে তুলনা করেছেন ফিনিক্স পাখির সঙ্গে, যাদের গল্প দারিদ্র্য আর নানা প্রতিবন্ধকতার ছাই থেকে জেগে ওঠার, পাখা মেলে সাফল্যের দিগন্তে ওড়ার।

আজ যখন দেখেন ৪৩-৪৪ বছর আগের সে নবজাতক ক্রিকেটের কুলীন সমাজের সদস্য, বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে চোখে চোখে রেখে লড়ছে শক্তিশালী দলগুলোর সঙ্গে, মারলারের বুকটা ভরে যায় গর্বে, ‘এটা আমার জন্য অনেক ভালো লাগার অনুভূতি। বাংলাদেশ বিশ্বকাপে ভালো করছে। আমি রোমাঞ্চিত, আমি অনেক অনেক খুশি। তবে ওই সফরটা ভুলতে পারি না, আমার জীবনের অন্যতম সেরা এক অভিজ্ঞতা ছিল যে সেটা।’

একজন ভিনদেশি সাংবাদিক হিসেবে বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রতি যাঁর এত মমতা, এত বড় অবদান—রবিন মারলার আপনাকেও ভুলবে না বাংলাদেশ ক্রিকেট।