অয়ন ভট্টাচার্য আমার বন্ধু। কদিন পরপর ঘড়ি কেনা ওর শখ। আমি প্রায়ই মুরব্বিভাব এনে বলতাম, ‘খালি সময় দেখলে হবে? সময়টা কাজে লাগা।’ অথচ অয়নের হাতে এখন হয়তো খুব বেশি সময় নেই! ওর হৃৎপিণ্ডে কঠিন এক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। চিকিৎসাবিদ্যার পরিভাষায় রোগটির নাম ‘ডিসেকটিং আনিউরিজম অব ডিসেন্ডিং অ্যান্ড অ্যাবডোমিনাল অ্যারোটা’। চিকিৎসকেরা বলছেন, অয়নের এই অসুখ অত্যন্ত জটিল, অতিদ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। অস্ত্রোপচার না হলে অয়নকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়বে। অয়নের বয়স মাত্র ৩০। এই বয়স কি সময় ফুরিয়ে যাওয়ার! তাই অয়নকে বলি, বন্ধু, আমাদের আরেকটু সময় দে!
২০০৯–১০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভর্তি পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। ফল দেখার সময় হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার চেয়ে এক হাত লম্বা একটা ছেলে চিৎকার করে বলছে, ‘দোস্ত, আমি ১০০তম হইছি, তোর কী অবস্থা?’
আমি খানিকটা বিস্ময় আর আনন্দজড়ানো কণ্ঠে চিৎকার করে বললাম, ‘দোস্ত, আমি তোর পেছনেই আছি—১০১!’
সেদিনের কথা কোনো দিনও ভুলব না! কেমন স্বপ্নময় একটা দিন ছিল! আর ওই সেদিন থেকেই অয়ন আমার প্রাণের বন্ধু হয়ে গেল। অয়ন ১০০, আমি ওর ‘ফলোয়ার’—১০১।
ফল প্রকাশের পর আমরা দুজনই চারুকলার ছাপচিত্র বিভাগে ভর্তি হলাম। একসঙ্গে অনার্স–মাস্টার্স পাস করলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষে আমি বিয়েও করে ফেললাম। অয়ন বলল, ‘কী রে মামা, তাইলে কি আমি একা থাকব?’
অয়ন থাকত জগন্নাথ হলে। আমি বিয়ের পরদিনই জগন্নাথ হলে গেলাম। বললাম, ‘আজকে তোর সাথেই থাকব।’
হাসতে হাসতে অয়নের অজ্ঞান হওয়ার দশা। বলল, ‘তোর বউ তোরে তো মারবই, আমারেও ছাড়ব না!’ আমি ইয়ার্কি করে বললাম, ‘বউ বড়, না বন্ধু বড়?’
আমাদের কর্মজীবনের ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তারপরও আমরা দূরে যাইনি। সময় পেলেই ঘুরতে যেতাম, খেতে যেতাম। আগের মতোই সুযোগ পেলে রাত জেগে ঘোরাঘুরিও করতাম। অয়ন কখনো কখনো অভিভাবকের মতো শাসন করত। কখনো প্রেমিকার মতো অভিমানও করে বসত!
করোনার প্রকোপ শুরু হলো। মা–বাবার চেয়ে অয়নই বেশি খোঁজখবর নিচ্ছিল। প্রতিদিন ফোন করত, ‘কী রে, ঠিক আছিস তো? সাবধানে থাকিস!’
অয়নের পাগলামির কথা মনে পড়লে আমি এখন কাঁদি! একদিন ক্লাসরুমের সামনে বসে আছি, অয়ন হাতে একটা অসুস্থ চড়ুই পাখি নিয়ে ছুটে এল। বলল, ‘চল আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
‘ঢাকা মেডিকেলে।’
গেলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজে। অয়নের হাতে পাখি দেখে ডাক্তার হতভম্ব। বললেন, ‘এটা তো পশু হাসপাতাল না! আপনি পশুপাখির হাসপাতালে যান।’
আমরা ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়ালাম। কী করব বুঝতে পারছি না। অয়ন তখন একটু পানি নিয়ে চড়ুইটার মুখে দিল। শেষমেশ চড়ুইটাকে আর বাঁচানো গেল না! অয়ন সেখানেই মাটি খুঁড়ে পাখিটিকে কবর দিল। কবর দিয়ে আসার পর ওর মন ভীষণ খারাপ। হাঁটতে হাঁটতে বলল, ‘একটা পাখিরে বাঁচাইতে পারলাম না রে, দোস্ত!’
আরেক দিনের কথা মনে পড়ছে। অয়ন এসে বলল, ‘কিছু টাকা দে তো।’
আমি বললাম, ‘কেন?’
অয়ন গাঁইগুঁই করে, বলতে চায় না। শুধু বলল, ফরম ফিলআপ করতে হবে। বেশ কিছুদিন পরে জানতে পারলাম, বাসা থেকে ফরম ফিলআপের জন্য যে টাকাটা ওর বাবা ওকে দিয়েছিলেন, সেটা ও আমাদের ক্যানটিনের এক বয়ের চিকিৎসার জন্য খরচ করেছে!
বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষের একটা ঘটনা বলি। আমরা ছিলাম চারুকলার ১৮তম ব্যাচ। ব্যাচের ১২০ জন শিক্ষাসফরে ভারত যাব বলে ঠিক হলো। সবাই ব্যস্ত, আনন্দে মুখর। একদিন জানা গেল, ভিসা জটিলতার কারণে আমাদের এক বন্ধু যেতে পারবে না। অয়ন মিটিংয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘যদি ইন্ডিয়া যাই, আমরা সবাই যাব। একজনকে রেখে যাব না।’
কেবল কথা বলেই ক্ষান্ত হলো না ও। ওই বন্ধুকে নিয়ে সে সময়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারের কাছে গেল অয়ন। স্যার ভারতীয় দূতাবাসে ফোন করে সমস্যার সমাধান করে দিলেন। অয়ন এমন নানা সমস্যার সমাধান করেছে, এটা ওর সহজাত বৈশিষ্ট্য।
সপ্তাহখানেক আগে অয়ন ফোন করে বলল, ‘একটু আসতে পারবি?’
আমি অফিস থেকে বের হয়ে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে গেলাম। শুনলাম, ও ডাক্তার দেখিয়েছে। রিপোর্ট দেবে। রিপোর্ট নিতে যাওয়ার সময় ও বলল, ‘আগে দেখ তো, নতুন ঘড়িটা কেমন।’
আমি বললাম, ‘সময় দেইখা লাভ নাই, চল, রিপোর্ট দেখি।’
কে জানত চিকিৎসক জানিয়ে দেবেন, ঘড়ির সময় দেখা আমার বন্ধুটার হাতে আর বেশি সময় নেই!
অসুখের খবর পাওয়ার পর অয়ন বলল, ‘ভাবি কী, আর হয় কী! ভাবছিলাম অফিস ছুটি নিয়ে আইএলটিএসের পড়াশোনা করব। কানাডায় থ্রিডি অ্যানিমেশন নিয়ে পড়ব। আর এখন দেখি একেবারেই ছুটি পেয়ে যাচ্ছি!’
কথাটা শোনার পর বুকের কোথায় যে মোচড় দিয়ে ওঠে, আমি বলতে পারব না! অয়নের বাড়ি ময়মনসিংহ শহরের পণ্ডিতবাড়ি এলাকায়। ওর মা ডলি রানী রায়, গৃহিণী। বাবা রবীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা। মা–বাবার দুই সন্তানের মধ্যে অয়ন ছোট।
অয়নের কাজেকর্মে, আচরণে মুগ্ধ হয় না, এমন মানুষ কমই দেখেছি। কী দারুণ সব ছবি আঁকে ও। মানুষ, প্রাণী, গাছপালা—এই পৃথিবীর জন্য ওর হৃদয়ে কত মমতা। অথচ চিকিৎসকেরা যা জানিয়েছেন, তার সারমর্ম হলো, ওর হৃৎপিণ্ডের ধমনিতে ছিদ্র খুঁজে পাওয়া গেছে। এর ফলে ও গভীর সংকটে পড়ছে প্রতিনিয়ত।
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের অধ্যাপক এম কামরুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছুদিন ধরেই চিকিৎসাধীন আছে অয়ন। কামরুল ইসলামের মতে, সর্বোচ্চ দ্রুততম সময়ের মধ্যে ওর অস্ত্রোপচার করানো প্রয়োজন। এবং ওকে ভারতের নয়াদিল্লির ম্যাক্স সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দিয়েছেন। অয়নের পরিবার সেখানে যোগাযোগ করেছে। সেখানকার প্রিন্সিপাল ডিরেক্টর (ভাসকুলার সার্জারি) কুমোদ রায় আশ্বস্ত করেছেন, তিনি এই অস্ত্রোপচার করবেন। তাঁর দেওয়া চিকিৎসাব্যয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশি টাকায় ৩০-৩৫ লাখ টাকা খরচ হবে শুধু অস্ত্রোপচারের জন্য।
অয়ন একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় চাকরি করে। অসুস্থ হওয়ার পর অফিস করতে পারছে না। ওর পরিবারের সামর্থ্য নেই এত টাকা জোগাড় করার। আমরা বন্ধুরা মিলে চেষ্টা করছি অয়নের চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগাড় করতে। কিন্তু আমরা হিমশিম খাচ্ছি। চাইলে আপনিও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন।
সাহায্য পাঠানোর ঠিকানা
১. অয়ন ভট্টাচার্য
সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর: ১৮–১৩৭৬৫২৪–০১
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, বসুন্ধরা শাখা
২. বিকাশ রঞ্জন কর্মকার (অয়নের ভগ্নিপতি)
সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর: ১১৩১২৬০০০১৪২৯
ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড, দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, ঢাকা
৩. বিকাশ নম্বর: ০১৬৮৭০৯৬০৪৭