বঙ্গবন্ধুর দিনলিপিতে বৃক্ষপ্রেম
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সংগ্রামমুখর জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাভোগ করেছেন। হিসাব করলে যা ১৩ বছরের মতো, আর দিনের হিসাবে ৪ হাজার ৬৮২ দিন। কেমন ছিল তাঁর কারাজীবন, কারাগারে কীভাবে সময় কাটিয়েছেন—এসবের একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায় তাঁর লেখা কারাগারের রোজনামচা বইয়ে। তাতে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন প্রতিদিনের কিছু বিশেষ মুহূর্তের স্মরণীয় ঘটনা। দিনলিপির এসব ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তাঁর উদ্যানপ্রীতি ও বৃক্ষপ্রেমের কথা।
বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতিগদ্যে মনোনিবেশ করলে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারব, তিনি অনেক গাছ ও ফুল চিনতেন। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, চারপাশের অনুপম প্রকৃতি ও উদ্ভিদের নান্দনিক বিন্যাস তাঁকে ব্যাকুল করত। তাঁর মন ছুঁয়ে যেত। এমনকি নিজের হাতে তৈরি বাগান এবং চারপাশের উদ্ভিদজগৎকে তিনি বন্ধুজ্ঞান করতেন। আত্মার আত্মীয় ভাবতে পছন্দ করতেন।
রোজনামচায় তিনি লিখেছেন, ‘ডাব খেয়ে পাইপ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আবার ফুলের বাগানে। একটা মাত্র বন্ধু ফুলের বাগান। ওকে আমি ভালবাসতে আরম্ভ করেছি। যাদের ভালবাসি ও স্নেহ করি, তারা তো কাছে থেকেও অনেক দূরে।’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-১২৩] কারাগারের নির্মম, নির্দয় এবং অস্থির সময়গুলোতে নিজের হাতে রচিত বাগান তাঁর মনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিত। তিনি লিখেছেন, ‘রাতে যখন ঘুমাতে পারি না তখন মনে হয় আর এখানে থাকব না। সকাল বেলা যখন ফুলের বাগানে বেড়াতে শুরু করি তখন রাতের কষ্ট ভুলে যাই। গাছতলায় চেয়ার পেতে বসে কাগজ অথবা বই পড়ি। ভোরের বাতাস আমার মন থেকে সকল দুঃখ মুছে নিয়ে যায়।’ [কারাগারের রোজনামচা, পৃষ্ঠা-২১৮]
কারাবাসের সময় তাঁর সেলের সামনে তিনি বাগান করেছেন। নিয়মিত পরিচর্যা করেছেন। ফুল ফোটার আনন্দে হয়েছেন বিমোহিত। বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছিলেন। সে সময় তিনি শুধু যে ফুলের বাগানই করেছিলেন তা নয়, কিছু গাছও লাগিয়েছিলেন। যেগুলোর মধ্যে একটি কামিনীগাছও ছিল। বৃষ্টিভেজা কামিনীর সৌরভ তাঁর মন-প্রাণ জুড়িয়ে দিত। জীবনের কঠিনতম দুঃসময়েও এসব গাছই তাঁকে সাময়িক স্বস্তি দিত। ১৯৬৬ সালের ২৪ জুন রোজনামচায় তিনি লিখলেন, ‘আমার ঘরের দরজার কাছে একটা কামিনী ও একটা শেফালি গাছ। কামিনী যখন ফুল দেয় আমার ঘরটা ফুলের গন্ধে ভরে থাকে। একটু দূরেই দুইটা আম আর একটা লেবু গাছ। বৃষ্টি পেয়ে গাছের সবুজ পাতাগুলি যেন আরও সবুজ আরও সুন্দর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বড় ভাল লাগল দেখতে। মাঠটা সবুজ দূর্বায় ভরে উঠেছে। তারপর গাছগুলো, বড় ভাল লাগলো। বাইরেই যেয়ে বসলাম। দেখলাম এদের প্রাণ ভরে। মনে হলো যেন নতুন রূপ নিয়েছে।’
শুধু ফুল-ফলই নয়, বঙ্গবন্ধু মনের আনন্দের জন্য সেখানে বিভিন্ন মৌসুমে সবজিও চাষ করতেন। তাঁর দিনলিপির পাতায় লাউ, ঝিঙা, বেগুন, টমেটো ইত্যাদি চাষের বিবরণ পাওয়া যায়। ১৯৬৬ সালের ২১ জুলাই তিনি লিখলেন, ‘ভীষণ গরমও পড়েছে। কিছু কিছু ব্যায়ামও করা শুরু করেছি। কারণ, রাতে ঘুম হয় না ভালভাবে। সন্ধ্যার পূর্বে কিছু বেগুন গাছ লাগালাম নিজের হাতে।’
বঙ্গবন্ধুর লেখা তিনটি বই ও তাঁর বিভিন্ন স্মৃতিকথায় প্রকৃতির হৃদয়ছোঁয়া বর্ণনা পাওয়া যায়। বাংলার শ্যামল প্রকৃতির সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এর আবেদন ও গুরুত্বকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক এসব আলাপচারিতা কখনো কখনো ফুলের অনুপম পুষ্পোদ্যান ছাড়িয়ে আবেগঘন পাখির রাজ্যেও পাখা মেলেছে।
কারাগারের বন্দিজীবনে দুটো হলুদ পাখির জন্য আকুতি আমাদের সামনে ভিন্ন এক বঙ্গবন্ধুকে উপস্থাপন করে। মা-বাবা ও স্বজন-সান্নিধ্যহীন একাকী জীবনে সেই পাখি দুটোই হয়ে উঠেছিল তাঁর বন্ধু ও পরম আত্মীয়। রোজনামচায় তিনি লিখছেন, ‘আমার ঘরটার কাছের আম গাছটিতে রোজ ১০টা-১১টার সময় দুইটা হলদে পাখি আসে। ওদের খেলা আমি দেখি। ওদের আমি ভালবেসে ফেলেছি বলে মনে হয়। ১৯৫৮ সালে দুইটা হলদে পাখি আসত। তাদের চেহারা আজও আমার মনে আছে। সেই দুইটা পাখির পরিবর্তে আর দুইটা পাখি আসে।...১৯৫৮ থেকে ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাখি দুইটা আসত। এবার এসে তাদের কথা আমার মনে আসে, আমি খুঁজতে শুরু করি। এবারও ঠিক একই সময় দু’টা হলদে পাখি এখানে আসত। মনে হয় ওদেরই বংশধর ওরা।...কয়েকদিন ওদের দেখতে পাই না। রোজই আমি ওদের খুঁজি। তারা কি আমার উপর রাগ করে চলে গেল? আর কি ওদের আমি দেখতে পাব না? বড় ব্যথা পাব ওরা ফিরে না আসলে। পাখি দুইটা যে আমার কত বড় বন্ধু যারা কারাগারে একাকী বন্দি থাকেন নাই তারা বুঝতে পারবেন না। আমাকে তো একেবারে একলা রেখেছে। গাছপালা, হলদে পাখি, চড়ুই পাখি আর কাকই তো আমার বন্ধু এই নির্জন প্রকোষ্ঠে।’ [১১ এপ্রিল–১৩ এপ্রিল ১৯৬৭]
বঙ্গবন্ধু ছিলেন এমনই, ফুল-পাখির মতো নরম কোমল আর স্নিগ্ধ মনের পরিপূর্ণ এক মানুষ।