কাজ থেকে বাড়ি ফিরলে সঙ্গী হয় সারা দিনের ক্লান্তি। কাঁধ থেকে নামতেই চায় না তা। চিঠি–চালাচালি, অফিসে বৈঠকের পর বৈঠক ইত্যাদি পর্বত পেরিয়ে বাড়ি ফিরলেও মানসিক চাপটা সরতে চায় না। আগামী দিনের ভাবনা আবার জাপটে ধরে, মাথাটা ব্যস্ত থাকে সেই ভাবনাতেই। সেই সঙ্গে বিষণ্নতার মতো কিছু যদি আপনার সহচর হয়, তাহলে তো কথাই নেই। রাতের নিরবচ্ছিন্ন ঘুমের কথা অবলীলায় ভুলে যেতে পারেন। তখন বাস্তবের কোনো বিষয় ঘুমের মধ্যে ড্রাকুলা হয়ে আপনার রক্ত শুষে নিতে চাইলে নির্ঘুম রাতই আপনার একমাত্র বন্ধু হতে পারে।
না, আপনাকে নির্ঘুম, ক্লান্তিকর, চাপযুক্ত রাতের বিভীষিকার মধ্যে নিক্ষেপ করার জন্য এ লেখা নয়। বরং তা থেকে মুক্তি দেওয়াই এর লক্ষ্য। ক্লান্ত, বিষণ্ন মানুষ আপনি, কিন্তু বাড়ি ফেরার পর ঘুমের আগে হাতে যদি আধা ঘণ্টাখানেক একটা বই থাকে এবং সে বই পড়ে যদি আনন্দ পান, তাহলে ঘুমের প্রশান্তি আসবেই। সারা দিনের ক্লান্তিকর যুদ্ধের ময়দান থেকে বেরিয়ে যেতে পারবেন একটা বইয়ের হাত ধরেই। বিশ্বাস করুন, এই বই মানসিক চাপ কমিয়ে দেবে, আপনার রাতটাকে করে তুলবে মোহময়।
যার যেমন পছন্দ, তেমন বইই পড়বেন। শুধু বই কেন, যদি পত্রিকার ম্যাগাজিন পড়তে ইচ্ছা করে, সেটাও রাখুন হাতের কাছে। মনের খোরাক মেটাবে যে লেখা, সেটাই পড়ুন। আমার একবার মনে হলো, বাংলায় রেনেসাঁ এসেছে কি আসেনি, এ বিষয়ে পড়তে হবে। পক্ষে–বিপক্ষে বুদ্ধিদীপ্ত বিশ্লেষণগুলো পড়ি আর মনে হয়, আরে! এটাই তো সত্যি। একসময় মনে হলো, ভারী হয়ে যাচ্ছে না তো? একটু অন্য রকম বই এখন টানবে তবে! তখন ভ্রমণকাহিনি পড়ার নেশা জাগল। পাঁচ–ছয় পৃষ্ঠা পড়ার পরই মনটা শান্ত হয়, পরে কী ঘটবে এবং বইয়ের পাতায় কীভাবে তার প্রতিফলন হবে, সে কথা ভেবে রোমাঞ্চ বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে যেতাম। এগুলো পড়তে পড়তেই মনে হলো সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে–বিদেশেটা আরেকবার ঝালিয়ে নেওয়া উচিত আর সুযোগ পেলে মঈনুস সুলতানের বইগুলোও পড়ে ফেলা দরকার। তারপর কবিতা বা গল্প–উপন্যাস তো আছেই। রান্নার বই পড়েও আনন্দ পেয়েছি, যখন দেখেছি, স্রেফ আদা আর ঘি দিয়ে রান্না করা যাচ্ছে রুই মাছ। অফিসের টেনশনের জায়গায় মাথায় জায়গা করে নিচ্ছে রান্নাঘর!
এমন নয় যে প্রতিদিন একটা করে বই শেষ করতে হবে। হয়তো পাঁচ পাতা পড়েই আপনি রেখে দিলেন বই। এরপর ঘুমিয়ে পড়লেন। পরদিন শুরু করলেন নতুন পাতায় ভ্রমণ। বাঙালি এখন জরিপ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে চায় না। একটা জরিপের কথাই বলি তবে। টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এক সংবাদে দেখছি, সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী মানসিক চাপ কমানোর বিষয়ে একটা জরিপ পরিচালনা করেন, সেখান থেকে বেরিয়ে আসে এক চমকপ্রদ খবর। ডা. ডেভিড লুইসের গবেষণা জানায়, ৬৮ শতাংশ মানসিক চাপ কমিয়ে দেয় পড়ার অভ্যাস। পড়ার অভ্যাস হারিয়ে দিয়েছে গান শোনা (৬১ শতাংশ), চা বা কফি পান (৫৪ শতাংশ) ও হাঁটাহাঁটি করাকেও (৪২ শতাংশ)।
ভালো একটা বই প্রতিদিনের মানসিক চাপ থেকে আপনার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে অন্যদিকে, যে বিষয়গুলো আপনার মনে চাপ তৈরি করে, সেগুলো থাকবে না আপনার সামনে। গল্পের মধ্যে ঢুকলেই আপনি পেয়ে যাবেন বাস্তবের বিপৎসংকুল জগতের চেয়ে আলাদা একটা মানবিক জগৎ, ফলে আপনার সমস্যা আর সংকটগুলো কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনাকে বিরক্ত করবে না। একটা সুন্দর মন নিয়ে আপনি ঘুমাতে যাবেন। আর হ্যাঁ, যখন আপনি পড়ছেন, তখন আপনার পেশিগুলোও অবসর পাচ্ছে, টান টান না থেকে শিথিল হচ্ছে, আপনার নিশ্বাস–প্রশ্বাস স্বাভাবিক হচ্ছে এবং হ্যাঁ, আপনি শান্তির পরশ পাচ্ছেন।
রাতে ঘুমের আগে পড়াশোনার ব্যাপারে বিল গেটসের নাম অনেকভাবেই এসেছে। আমরা শুধু মনে করিয়ে দেব, বিল গেটস রাতের এই পড়াশোনাকে ঘুমের প্রস্তুতিরই একটা অংশ বলে মনে করেন। তিনি খুব দ্রুত পড়তে পারেন, তাঁর পড়ার বিষয়বস্তুও বৈচিত্র্যময়।