বই আর গাছ বিলান মাহমুদুল
মাহমুদুলদের বাড়িটা বেশ খানিকটা জায়গাজুড়ে। বাড়ির ভেতরে বেশ কিছু ফলদ আর বনজ গাছপালা। ছায়া-সুনিবিড় এমন পরিবেশে বেড়ে ওঠা তরুণ মাহমুদুল ইসলামের তাই স্বপ্ন জাগে প্রকৃতি আর পরিবেশকে সবুজ রাখার পাশাপাশি আলোর প্রদীপ ছড়ানোর। এমন স্বপ্ন নিয়েই পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে নিজের টাকায় গাছের চারা কিনে বিতরণ করে আসছেন ছয় বছর ধরে। এ ছাড়া পাড়া-মহল্লায় শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সী মানুষকে জড়ো করে বসাচ্ছেন সাহিত্যপাঠের আড্ডা, উপহার দিচ্ছেন বই। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের জন্য নিজের বাড়িতে বিনা মূল্যে গড়ে তুলেছেন ‘সন্ধ্যা রাতের পাঠশালা’। দিনে দিনে তিনি যেন হয়ে উঠেছেন বই আর গাছের ফেরিওয়ালা।
২০১৩ সালের কথা। তখন রংপুরের কারমাইকেল কলেজে বাংলায় স্নাতক করছেন মাহমুদুল ইসলাম। মা–বাবার পাঠানো টাকা থেকে কিছু টাকা বাঁচিয়ে প্রতিবার ছুটিতে বাড়িতে যাওয়ার সময় রংপুর থেকে নানা জাতের ফলদ আর বনজ গাছের চারা নিয়ে যেতেন তিনি। রোপণ করতেন বাড়ির আশপাশে।
একটা সময় পুরো গ্রামকে নিয়ে ভাবতে থাকেন মাহমুদুল। নিজের টাকা দিয়ে কেনা গাছের চারা বিতরণ শুরু করেন স্থানীয় ব্যক্তিদের। প্রিয় বাইসাইকেলটি নিয়ে পাড়া–প্রতিবেশীদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গাছের চারা বিতরণ শুরু করেন তিনি। গাছ আর বই নিয়ে নিজের উদ্যোগের শুরুর গল্প এভাবেই শোনান মাহমুদুল।
>নিজ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী ১০ গ্রামে কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন মাহমুদুল। এ ছাড়া ঢাকা, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর যখন যে শহরেই যান, সে শহরেই গাছের চারা রোপণ করেন। বই নিয়ে কথা বলেন মানুষের সঙ্গে।
২০১৬ সালে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষ করে বাড়িতে এসে বাড়িয়ে দেন গাছ আর বই বিতরণের কাজের পরিধি। চাকরির পেছনে না ছুটে হতদরিদ্র, মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের বাড়িতে বিনা মূল্যে পড়ান প্রতি সন্ধ্যায়। মাহমুদুল যার নাম দিয়েছেন ‘সন্ধ্যা রাতের পাঠশালা’। শিশুরা তাঁর কাছে পড়ালেখা শেখে বিনা মূল্যে। বর্তমানে তাঁর এই পাঠশালায় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০। এ ছাড়া গ্রামগুলোয় গাছের চারা বিতরণের পাশাপাশি তিনি বসান সাহিত্যপাঠের আড্ডা। এলাকার নারী, শিশু-কিশোরসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজনকে জড়ো করে বিভিন্ন লেখকের বই পাঠ করে শোনান তিনি। মাহমুদুল ইসলাম বলছিলেন, ‘আমার এসব কাজের সবচেয়ে অনুপ্রেরণা জোগান আমার মা। বাবাও সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন। মা–বাবার আর্থিক সহযোগিতায় নিজেই হাঁস–মুরগির একটি ছোট খামার গড়ে তুলেছি। ডিম ও মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে গাছের চারা ও বই কেনা হয়। এ ছাড়া বাবার একটা ছোট চা–বাগান আছে, সেখানেও দেখাশোনা করি। এসব থেকে আয়ের একটি অংশ দিয়ে বই আর চারা কিনি।’
নিজ গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী ১০ গ্রামে কয়েক হাজার গাছ লাগিয়েছেন মাহমুদুল। এ ছাড়া ঢাকা, রংপুর, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর যখন যে শহরেই যান, সে শহরেই গাছের চারা রোপণ করেন। বই নিয়ে কথা বলেন মানুষের সঙ্গে। শুধু গাছপাগলই নন মাহমুদুল, বাংলা সাহিত্যের প্রতিও ব্যাপক ঝোঁক রয়েছে তাঁর। শিশু–কিশোর ও তরুণদের বিনা মূল্যে সাহিত্য বই উপহার দেওয়ার পাশাপাশি সেলিনা হোসেন, হুমায়ূন আহমেদ, আনিসুল হক, মুহম্মদ জাফর ইকবালসহ দেশবরেণ্য লেখকদের বিভিন্ন বই থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বইগুলো তাঁর সংগ্রহে রয়েছে।
মাহমুদুলের এমন কাজ সম্পর্কে স্থানীয় স্কুলশিক্ষক আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘মাহমুদুল আমাদের সমাজের একটি অনন্য দৃষ্টান্ত। বর্তমান সমাজে কয়জন আছেন এভাবে প্রকৃতি, পরিবেশ আর সাহিত্য নিয়ে ভাবার। তার কাজ আমাদের মুগ্ধ করে।’