অর্জন–ব্যর্থতার ২০২১
প্রথম বিশ্বকাপ স্মরণীয় করে রাখতে চান নারী ক্রিকেটাররা
বছরজুড়েই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজ যোগ্যতাবলেই এগিয়েছেন দেশের নারীরা। অগ্রযাত্রার মধ্যেও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাও ছিল আলোচিত। দুদিকেই ফিরে তাকিয়েছে নারীমঞ্চ। এখানে বাংলাদেশ ক্রিকেটের নারী দলের সাফল্যের কথা
‘ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ খেললে তারপর বিয়ের কথা ভাবব’—কথাটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের নারী দলের এক সদস্যের। প্রতিবারই মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলে বাদ পড়ার হতাশাটা এই ক্রিকেটারের কথায় মেশানো। দেশকে ওয়ানডে বিশ্বকাপের বৈতরণি পার করানোর জন্য নিজের বিয়েও যে আটকে রেখেছেন তিনি! গত নভেম্বরে জিম্বাবুয়ের মাটিতে সেই বাধা জয় করেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। র্যাঙ্কিংয়ে এগিয়ে থেকে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের টিকিট পেয়েছে বাংলাদেশ নারী দল। ২০২২ সালের মার্চে নিউজিল্যান্ডে অনুষ্ঠেয় মেয়েদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে হবে বাংলাদেশের অভিষেক।
এখন থেকেই বিশ্বকাপের ছক আঁকছেন নারী দলের অধিনায়ক নিগার সুলতানা। তাঁর আশা, বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের মিশেল আগামী মার্চের বিশ্বকাপেও থাকবে। বিশেষ করে নারী দলের অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের জন্য প্রথম ওয়ানডে বিশ্বকাপটা স্মরণীয় করে রাখতে চাইবে নিগার সুলতানার দল। রুমানা আহমেদ, সালমা খাতুন, জাহানারা আলমদের মতো অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের কথা উল্লেখ করে তিনি বলছিলেন, ‘বাছাইপর্বের খেলায় সবার মধ্যেই তাড়না ছিল, এবার যেন আমরা এই বাধাটা পার করতে পারি। দলে অনেক সিনিয়র ক্রিকেটার ছিলেন, যাঁদের আরেকটি বিশ্বকাপের জন্য চার বছর অপেক্ষা করা বা খেলা চালিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তাই আমরাও দল হিসেবে চেয়েছিলাম, তাঁদের জন্য হলেও যেন এবার বাছাইপর্ব পার করি। বিশ্বকাপেও এটা ধরে রাখার চেষ্টা থাকবে।’
এবার বিশ্বকাপ খেলতে না পারলে অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের অনেকেরই খেলা ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল। খুলনা বিভাগের কোচ ইমতিয়াজ হোসেনের হাত ধরেই ক্রিকেটে হাতেখড়ি সালমা-রুমানাদের। এবার বিশ্বকাপের টিকিট না মিললে যে কী হতো, সেই আভাস নাকি প্রিয় কোচকে দেশ ছাড়াই আগেই দিয়েছিলেন অনেকে। ‘এই মেয়েরা স্বপ্ন দেখার সাহসটা দেখিয়েছিল। যখন শুরু করেছিল, তখন বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্ন দেখেছিল ওরা। তবে অপেক্ষাটা দীর্ঘ ছিল। এবার না হলে আবার ২০২৬ পর্যন্ত অপেক্ষা করা কঠিন হতো। তাই অনেকেই খেলা ছাড়ার চিন্তাও করেছিল,’ বলছিলেন ইমতিয়াজ হোসেন।
বাংলাদেশের মেয়েরা নিউজিল্যান্ডেও যেন জয়ের সেই বলয়ের ভেতরেই থাকতে পারেন, সেই চেষ্টা করছেন নারী দলের কোচ এ কে এম মাহমুদুল ইমন
দেরিতে হলেও বাংলাদেশের মেয়েরা কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছেছে। বিশ্বকাপ নিশ্চিত হওয়ার খবর শোনার পর রুমানার খুশিতে কান্নায় ভেঙে পড়া ভাইরাল ভিডিওটি সেই গল্পই বলে। সেই রুমানাকে আবার ওই মুহূর্তে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন জাহানারা। বুকে জড়িয়ে কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমরা করে দেখিয়েছি। আমাদের কষ্টের ফল আমরা পেয়েছি।’ সেদিন রুমানা নিজের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘এটা আসলে আমাদের অনেক দিনের চেষ্টার ফল। নিজেদের প্রমাণ করে আমরা বিশ্বকাপে পৌঁছেছি।’
এসবের শুরুটা হয়েছে পাকিস্তানের বিপক্ষে অবিশ্বাস্য জয় দিয়ে। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে রুমানার অপরাজিত ৫০ রান বাংলাদেশকে রোমাঞ্চকর জয় এনে দিয়েছে। তখন আবার বাংলাদেশের ছেলেরা ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে একের পর এক ম্যাচ হেরেই চলেছেন। বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব ও তার আগের জিম্বাবুয়ে সিরিজে দারুণ ফর্মে থাকা বাঁহাতি স্পিনার নাহিদা আক্তার যা বললেন, তাতে মনে হলো, ছেলেদের হয়েই যেন মেয়েরা প্রতিশোধ নিতে মুখিয়ে ছিলেন! তিনি বলছিলেন, ‘পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলা হলে আমরা এমনিতেই একটু বাড়তি অনুপ্রাণিত থাকি। আর তখন আমাদের ছেলেরা পাকিস্তানের কাছে হারছিল। তখন মনে হয়েছিল, যদি পাকিস্তানকে হারাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের জন্য ভালো হতো। শেষ পর্যন্ত সেটাই করেছি। আর ওই জয়ে আমাদের টুর্নামেন্টটাও সহজ হয়ে গিয়েছিল। এরপর আমরা একটা বলয়ে ঢুকে পড়ি।’
বাংলাদেশের মেয়েরা নিউজিল্যান্ডেও যেন জয়ের সেই বলয়ের ভেতরেই থাকতে পারেন, সেই চেষ্টা করছেন নারী দলের কোচ এ কে এম মাহমুদুল ইমন। জিম্বাবুয়ে থেকে দেশে ফেরার পর দলের দুজনের অমিক্রন ধরা পড়ায় নারী দলের প্রস্তুতির সময়সূচি এলোমেলো হয়ে গেছে। দলের সিংহভাগ ক্রিকেটারকে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দুজন বন্দী ছিলেন ২০ দিন। আবার মার্চে নিউজিল্যান্ডে গেলে থাকছে আরও ১১ দিনের কোয়ারেন্টিন। এর ফাঁকে যতটা সম্ভব প্রস্তুতি নেবেন বাংলাদেশের মেয়েরা। দুই দিন হলো মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে নারী দলের প্রস্তুতি ক্যাম্প শুরু হয়েছে। কদিন পরই মেয়েদের কমনওয়েলথ গেমস খেলতে মালয়েশিয়া যাবে নারী দল। কোয়ারেন্টিনসহ সফরের ফাঁকে ফাঁকে যতটা সময় পাওয়া যায়, সেটা নিয়েই কাজ করছেন কোচ মাহমুদুল ইমন, ‘আমরা কিছুদিন আগে নিউজিল্যান্ডে যাব। সেখানেও যেহেতু কোয়ারেন্টিন, যা সময় পাই, সেটাই কাজে লাগাব প্রস্তুতির জন্য।’
করোনার কারণে প্রায় কোনো প্রতিযোগিতাপূর্ণ ক্রিকেট না খেলেই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের চ্যালেঞ্জ উতরে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। কোয়ারেন্টিন, সফর, নিউজিল্যান্ডের অচেনা কন্ডিশন—এসব জয় করার আত্মবিশ্বাসটা এখন নারী দলের আছে। অধিনায়ক নিগার যেমন বলছিলেন, ‘আমরা নিখুঁত পরিকল্পনা করে বিশ্বকাপে এসেছি, এবারও তাই করব। আশা করি, ভালো হবে।’
নিগারের কাছে যেটা ‘ভালো’ সেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে হবে ইতিহাস। বাংলাদেশ যে প্রথমবারের মতো নারী ওয়ানডে বিশ্বকাপে খেলবে। আর প্রথম সবকিছুই যে বিশেষ!