প্রকৌশলী, ব্রেকড্যান্সার অথবা এক যাযাবর
বাইরের বিশ্বে চাকরির দুনিয়া যে কতটা বদলে গেছে, সেটা বোঝা যায় নাদির হোসেনের সিভি দেখলে। গ্রেড, সিজিপিএ, দক্ষতার ফিরিস্তি—এসবের কোনো কিছুই তাঁর সিভিতে নেই। জীবনবৃত্তান্তে আছে একটা গল্প। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন তরুণ নাদির হোসেনের ভাষায় ‘টাইমলাইন’।
ছোট ছোট ছবি আর ৮ থেকে ১০ শব্দের একেকটা বাক্য দিয়ে নাদির তাঁর পুরো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো তুলে ধরেছেন এই টাইমলাইনে। সেখানে ছোটবেলায় ‘অদ্ভুত’ নামের কারণে স্কুলে মার খাওয়ার কথা যেমন আছে, তেমনি জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি যে ৪০ পাউন্ড ওজন কমিয়েছেন, আছে সে কথাও। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া স্যান ডিয়েগো (ইউসিএসডি) থেকে যন্ত্রকৌশলে স্নাতক হয়ে কীভাবে তিনি নানা নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হলেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করলেন, সব এ গল্পেরই অংশ। টাইমলাইনে একনজর চোখ বোলালেই আপনার জানা হয়ে যাবে নাদির একসময় ডাক্তার হতে চেয়েছিলেন, ব্রেকড্যান্সের প্রতি তাঁর ঝোঁক আছে। আর এখন তিনি কাজ করছেন বিখ্যাত বৈদ্যুতিক গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠান টেসলার স্পেশাল অপারেশনস লিড হিসেবে।
করোনাকালে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’–এর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকে যখন ক্লান্ত, নাদির আবিষ্কার করেছেন এক নতুন ধারণা—‘ওয়ার্ক ফ্রম ভ্যান’। সহজ করে বললে—১২ আসনের একটা মার্সিডিজ স্প্রিন্টার ভ্যানের ভেতরটা ফাঁকা করে সেখানেই ছোট্ট ঘর সাজিয়েছেন নাদির। ভ্রাম্যমাণ এ ঘরে রান্নার ব্যবস্থা আছে। আছে বিছানা, ওয়াই–ফাই সুবিধা। সবচেয়ে বড় কথা—ঘরবন্দী থেকেও দেশজুড়ে ঘুরে বেড়ানোর আনন্দ।
জুম সফটওয়্যারের মাধ্যমে নেওয়া সাক্ষাৎকারে নাদির আমাদের বলেন, ‘ধরুন, দুটো ই–মেইল করার মাঝখানে ভ্যানের দরজা খুলে দাঁড়ালাম। আশপাশের পরিবেশ উপভোগ করলাম। আবার চোখের সামনে একই দৃশ্য বেশিক্ষণ ভালো লাগল না? ভ্যান নিয়ে অন্য কোথাও চলে গেলাম। চেক–ইন, চেক–আউটের ঝামেলা নেই। স্বাধীন।’
বাঁকবদল বারবার
প্রিমেডিকেল কোর্সের অংশ হিসেবে অস্ত্রোপচার দেখতে গিয়ে জ্ঞান হারিয়ে না ফেললে নাদির হোসেন হয়তো চিকিৎসকই হতেন। পড়ালেখা শেষে কিউএ কনস্ট্রাকশন নামের নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে নয়, তাঁকে হয়তো পাওয়া যেত কোনো হাসপাতালে।
কিউএ কনস্ট্রাকশন নাদিরের জীবনে বড় প্রভাব ফেলেছে। কেবল এ কারণেই নয় যে—এই প্রতিষ্ঠানে কাজের সুবাদে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভাসমান সেতু (যুক্তরাষ্ট্রের ফাইভটোয়েন্টি ব্রিজ) তৈরির কর্মযজ্ঞে অংশ নিতে পেরেছেন। বরং কাজের বাইরের অভিজ্ঞতাগুলোই তাঁর জন্য বড় ছিল।
নাদির বলেন, ‘এই কাজের জন্য আমাকে সিয়াটলে যেতে হয়েছিল। নতুন শহর। কাউকে চিনি না। তার ওপর যাঁদের সঙ্গে কাজ করি, তাঁরা দেখতে কেউই আমার মতো নন। একেকজন বিশালদেহী শ্বেতাঙ্গ। সব সময় তামাক চিবোচ্ছেন। আর আমি টাইটফিট প্যান্ট পরা লস অ্যাঞ্জেলেসের এক তরুণ।’ ভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গিয়েই নাদির আবিষ্কার করলেন, নিজের পরিচয় আসলে নিজেকেই গড়ে তুলতে হয়।
সিয়াটলের একাকী সময়টাতে নাদির বিভিন্ন কনসার্টে যেতে শুরু করলেন। মানুষের সঙ্গে মিশলেন। দিনের কাজ শেষে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ব্রেকড্যান্স শেখাতেন তিনি। নাদির বলেন, ‘জীবনে আমি নানা ধরনের কাজ করেছি। বেশির ভাগ কাজে টাকা ছিল না, তবে মজা ছিল।’
এই ‘মজা’র খোঁজেই যেকোনো সুযোগ কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন নাদির হোসেন। এক জায়গায় থিতু হওয়ার মানুষ নন ৩১ বছর বয়সী এই যুবক। তারুণ্যের ইতিবাচক শক্তিটাকে সব সময় কাজে লাগাতে চান। আলাপের একপর্যায়ে বলছিলেন, ‘গত এক সপ্তাহে আমার জীবনে নতুন কিছু ঘটেনি, তা ভেবেই দুশ্চিন্তা হচ্ছে!’
টেসলার অভিজ্ঞতা
সান ফ্র্যান্সিসকোতে টেসলার মূল কার্যালয়ে গিয়ে প্রথমবার বেশ ধাক্কা খেয়েছিলেন নাদির। বিশাল অফিস। কিন্তু মাঝখানে কোনো দেয়াল নেই। নাদিরের ভাষায়, ‘প্রায় শ পাঁচেক মাথা। সবাই একেকটা কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো কাজ করছে। ব্যাপারটা বেশ রোমাঞ্চকর।’
২০১৮ সাল থেকে টেসলায় যুক্ত হলেন নাদির। সেখানে আপনার কাজটা মূলত কী? জানতে চাই।
‘যুক্তরাষ্ট্রে যত বৈদ্যুতিক গাড়ি আছে, তার অধিকাংশই টেসলার। কিন্তু মুশকিল হলো, গ্যাস বা তেলের স্টেশন যতটা সহজলভ্য, চার্জিং স্টেশন তত নয়। তা ছাড়া একটা গাড়ি চার্জ করতে ২০ থেকে ৩০ মিনিট সময় লেগে যায়। দেখা যায় চার্জিং স্টেশনগুলোর সামনে গাড়ির দীর্ঘ লাইন। এই সমস্যা কীভাবে দূর করা যায়, সেটা নিয়েই আমার কাজ।’ বলেন নাদির।
চমকপ্রদ একটা প্রকল্পের কথাও বললেন নাদির। ভ্রাম্যমাণ একটি চার্জিং স্টেশন তৈরি করেছে টেসলা। একটা ট্রাকের ওপর বসানো বিশাল এক ব্যাটারি। তা দিয়ে একসঙ্গে আটটা গাড়ি চার্জ করা যায়। নাদির বলেন, ‘বাংলাদেশে বসুন্ধরা বলে একটা শপিং মল আছে না? ধরুন এই ব্যাটারি দিয়ে বসুন্ধরার মতো তিনটি ভবনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে।’
পরিবার
২০১৬ সালে শেষবার বাংলাদেশে এসেছিলেন নাদির হোসেন। তাঁর বাবা তোফাজ্জল হোসেন ও মা শাহিদা হোসেনের বাড়ি কুমিল্লায়। নাদিরের জন্মের আগেই তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন। বোন ন্যান্সি হককে নিয়েও যে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সে কথা নাদিরই মনে করিয়ে দিলেন।
প্রযুক্তি দুনিয়ার ‘রাজধানী’খ্যাত সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ তরুণ নির্বাহী, উদ্যোক্তা ও পেশাজীবীদের তালিকা তৈরি করে সিলিকন ভ্যালি বিজনেস জার্নাল। গত বছর তাদের প্রকাশিত ‘ফোরটি আন্ডার ফোরটি’ তালিকায় স্থান পেয়েছিলেন ন্যান্সি হক।
বাংলাদেশের কোন বিষয়টি সবচেয়ে ভালো লাগে? প্রশ্নের উত্তরটা অনুমান করতে পারছিলাম। তাই আগেই শর্ত জুড়ে দিলাম, ‘খাবার ছাড়া’। নাদির হেসে বললেন, ‘আমি খিচুড়ির কথাই বলতে যাচ্ছিলাম।’
একটু ভেবে যোগ করলেন নাদিম, ‘আমার কাজিনদের সুবাদে বাংলাদেশের অনেক তরুণের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। তাদের সৃজনশীলতা ও প্রতিভা আমাকে মুগ্ধ করে। সত্তর বা আশির দশকে বাংলাদেশ অনেক লড়াই পার করে এসেছে। এখন দেশটাকে যারা এগিয়ে নিচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই তরুণ। পৃথিবীতে এমন দেশ কিন্তু খুব বেশি নেই।’