ফ্যাশন
প্রকৃতির সুর ও ছন্দে
পাহাড় আর ঝরনার রং যেন এসে লেগেছে পোশাকের নকশায়। প্রকৃিতর অপরূপ দৃশ্য যেমন মনের শান্তি এনে দেয়, এই অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ডিজাইনার তেনজিং চাকমার নকশা করা পোশাকেও যেন আনে আরাম আর স্বস্তি। রাঙামাটিতে িগয়ে নকশার এই িবশেষ আয়োজনে তুলে ধরা হলো প্রকৃতি আর েপাশাকের মেলবন্ধন
কোথায় যাচ্ছি জানি না। শুধু জানি, ‘এই ঝরনার খোঁজ সাধারণ মানুষ জানে না।’ ডিজাইনার তেনজিং চাকমা আমাদের তেমনটাই বলেছেন। প্রথম আলোর ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নকশার বিশেষ প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের অংশ এই ফটোশুট। ঢাকা থেকে এসেছি আমরা তিনজন। সেই সঙ্গে স্থানীয় দুজন মডেলসহ তেনজিং চাকমার পোশাক ও দলবল নিয়ে আমরা চলেছি গহিন অরণ্যে ঝরনার পথে।
রাঙামাটির এই ডিজাইনার এখানে বসেই বাজিমাত কর চলেছেন দেশে-বিদেশে। পাহাড়ের ঐতিহ্যবাহী কোমরতাঁতের নকশাকে প্রাধান্য দিয়ে বানাচ্ছেন আধুনিক ডিজাইনের পোশাক।
‘ঢাকা শহর থেকে এত দূরে বসেও হাল ফ্যাশনের পোশাক বানাতে অসুবিধা হয় না?’ প্রশ্নটি তেনজিং চাকমাকে করেছিলাম শহরের বটতলার ঘাট থেকে আমাদের নৌকা ছেড়ে যাওয়ার সময়।
উত্তর পেলাম চার ঘণ্টা পর, নাম না-জানা সেই ঝরনার সামনে দাঁড়িয়ে। ‘সৃজনশীল কাজের অনুপ্রেরণা প্রকৃতি থেকেই বেশি মেলে। আর করোনাকাল তো আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে স্থান কোনো ব্যাপার নয়। সবখানে থেকে সব কাজ করা সম্ভব।’
এই দুধসাদা ঝরনার সামনে তখন কাঁচামিঠে রোদ এসে পড়ছে স্পট লাইটের মতো। পাথুরে পাহাড়ের গা ঘিরে রেখেছে ঘন সবুজ। দুই মডেল তৈরি হয়ে যখন ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়ালেন, মনে হলো যেন রূপকথার পাতা থেকে এখনই রাজকুমার এসে দাঁড়াবেন তাঁদের সামনে। নরম সুতি কাপড়ের এই লম্বা কামিজগুলো মূলত আরামের কথা চিন্তা করেই নকশা করা। লম্বা ঢোলা হাতার শেষ প্রান্তে সাদা পাইপিং করা। নিচের দিকে ঘন কুঁচি আর সাদা লেইস ব্যবহার করা হয়েছে। সাদার সঙ্গে নরম হলুদ আর হালকা গোলাপি রঙের শেড বাড়িয়েছে ঔজ্জ্বল্য।
শৈশবের রংগুলো
সৃজনশীল মানুষের কল্পনার আকাশ এমনিতেই থাকে অবারিত। তার কল্পনাকে আরেকটু উসকে দিতে রাঙামাটির পাহাড়, মেঘ আর নীল জলের লুকোচুরিই যথেষ্ট। তেনজিং চাকমা বলেন, ‘শৈশবের কিছু রং আমাদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে নিজের অজান্তেই। গরমের কথা ভেবে তেমনই কিছু পোশাকের নকশা করেছি এবার। সাদার সঙ্গে যেখানে নিয়েছি কিছু ক্যান্ডি কালার, যা চোখের জন্যও আরামদায়ক। কাপড়ের ওপরে ছোট ছোট বলপ্রিন্ট কিংবা পোলকা ডটের নকশাও; অনেকটা স্মৃতির ঝাঁপি খুলে ধরার মতো।’
এসব পুঁজি করেই পোশাকের নকশা করেন পাহাড়ের ডিজাইনার তেনজিং। পিচ্ছিল পাথর আর উঁচু-নিচু পাহাড়ি ঝিরিপথ বেয়ে আমরা এবার থামলাম খানিকটা খোলা জায়গায়। ঠিক বিদেশি সিনেমায় সোনালি চুলের নায়িকারা যেভাবে এক্কাদোক্কা খেলার মতো পা ফেলে বুনো পথে পাহাড়ি ঝরনা খুঁজে এগিয়ে চলে, সে রকম। শুভ্র পোশাকে ঝুড়ি ভরে বুনো ফুল তুলে এগিয়ে চলেছেন মডেল, হালকা হাওয়ায় তাঁর হাসিমুখের সঙ্গে চুলগুলো যেন প্রজাপতির মতো উড়ছে। তেনজিং বলেন, ‘এই সাদা পোশাকের মধ্যেও আছে নস্টালজিয়া। এখানে ব্যবহার করা লেইসের নকশা দেখলেই সেটা যে কেউ বুঝে যাবে। এটাও ঐতিহ্যবাহী, সুতির লেইস।’
প্রকৃতির সঙ্গে পোশাকের মেজাজ
ফিরতি পথে ঝিরিপথের ওপরে পড়ে থাকা এক প্রকাণ্ড গাছের সামনে থামলাম আমরা। তেনজিং এবার মডেলদের সাজাতে লাগলেন খানিকটা শুষ্ক মৌসুমের মতো করে। পাহাড়ি কোমরতাঁতে বোনা মোটা কালো কাপড়ের লম্বা স্কার্টের ওপর কালো একটা টপ আর তার ওপর রঙিন খাটো জ্যাকেট। কোমরে মোটা বেল্ট আর জাঙ্ক জুয়েলারিতে খানিকটা পশ্চিমা আবহ। আরেকজনকে পরালেন লম্বা হাতাকাটা গাউনের ওপরে বর্ণিল পাহাড়ি নকশার জ্যাকেট। এমন জায়গার সঙ্গে এই পোশাকের বাইরে কিছু ভাবা কঠিন। পশ্চিমা কাটের এই পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে গয়না পরানো হয় মডেলদের।
ছবি তুলতে তুলতে আমরা এতই গভীরে চলে এসেছি যে আমাদের দলে থাকা স্থানীয় এক পাহাড়ি তরুণ জানালেন, দ্রুত এই জায়গা ছাড়তে হবে আমাদের। কারণ, এখানে পড়ন্ত বিকেলে ভাল্লুক হানা দেয় মাঝেমধ্যে।
ফলে দ্রুত গাঁট্টি-বোঁচকা গুছিয়ে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম নৌকার দিকে। থমথমে নির্জন সেই পথে হঠাৎ কড়মড়ে একটা শব্দ। পুরো দল ৪৫ ডিগ্রি ঘুরে পেছন ফিরল। হেসে উঠলেন দলের সবচেয়ে পেছনে থাকা লোকটি, ‘শুকনো ডালে পাড়া লেগেছে।’ প্রাণে যেন পানি এল। দ্রুত উঠে এলাম নৌকায়।
সাঁঝের মায়ায়
চলছি সবুজ পাহাড়ের সীমানার ভেতর নীল জলের ওপর দিয়ে। সকালে মাথার ওপর শরতের যে ঝকঝকে আকাশ ছিল, এখন সেটা হেলান দিয়েছে পাহাড়ে। আমাদের গল্পের গাড়ি চলছে গড়গড়িয়ে আর ইঞ্জিনের নৌকা বেরিয়ে যাচ্ছে নীল জল কেটে। বিকেলের আলোয় এবার আমরা মডেলদের পরালাম খানিকটা খাটো গোল ফ্রক। কালো রঙের সেই ফ্রকের নকশা করা হয়েছে ট্রাইবাল মোটিফে।
শেষ ছবিটা তুলতে তুলতেই সূর্যপটে কনে দেখা আলোতে ইতো লাহলো পার্টি লুকের সেই ছবি।গোলাপি নেটের স্কার্টের ওপরে বাহারি রঙের জ্যাকেট।হাতে একগুচ্ছ রঙিন ফুল।কাপ্তাই লেকের মধ্যে একখণ্ড পাহাড় চূড়ায় তোলা সেই ছবিতে ধরা থাকল রঙিন এক বাংলাদেশের ছবি।একেক ঋতুতে বদলে যাওয়া এই প্রকৃতিতে ফ্যাশনও বদলে যেতে থাকে আবহাওয়া বুঝে।আর নকশা ভালোবাসা ভরে চেষ্টা করে পাঠকদের সেই বদলে যাওয়া সময়ের সঙ্গে থাকতে।এই যে নতুন একটি নাম না-জানা ঝরনা আর পাহাড়ি পথের সৌন্দর্য দেখাতে গহিনে যাত্রা, সেতো পাঠকদের জন্যই।