প্রকৃতির সান্নিধ্যে পড়ালেখা
টিলার ভাঁজে ভাঁজে চা-গাছ আর নানা প্রজাতির ফলদ গাছগাছালি। অপার সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে আছে নানা জাত ও রঙের বনফুল। দূরে মেঘালয়ের পাহাড় থেকে নেমে আসছে ঝরনা। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। একটু দূরে বড় জলাশয়, সেখানে হিজল-করচের বাগান। প্রকৃতির এমনই স্নিগ্ধ পরিবেশে দাঁড়িয়ে রয়েছে জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল। সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার শ্রীপুরে প্রতিষ্ঠিত নান্দনিক এই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠছে প্রকৃতির সান্নিধ্যে। পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও কারিগরিনির্ভর জ্ঞান অর্জনেও তারা পাঠ নিচ্ছে।
প্রকৃতির সান্নিধ্যে পড়াশোনা—বাংলাদেশে এমন প্রতিষ্ঠান প্রায় বিরল। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বেশ কয়েকটি ভ্যালি স্কুল আছে, তবে বাংলাদেশে ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল চালুর ঘটনা এ প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে প্রথমবার ঘটল বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্তৃপক্ষ দাবি করছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠাতা হাফিজ আহমেদ মজুমদার বেসরকারিভাবে দেশে ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল চালুর সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী ২০১৮ সালে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি এবং একাদশ শ্রেণিতে প্রথম ব্যাচ ভর্তির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরু হয়। হাফিজ আহমেদ মজুমদারের সঙ্গে ঢাকা ও সিলেটের তাঁর ব্যবসায়িক বন্ধুরাও রয়েছেন।
সম্পূর্ণ আবাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে পাঠদান করা হয়। খেলাধুলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থার পাশাপাশি অভিজ্ঞ দেশি-বিদেশি শিক্ষকমণ্ডলী দ্বারা এই প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবেশবান্ধব আবাসনব্যবস্থার পাশাপাশি নিয়মিত মানসম্পন্ন ও পুষ্টিকর খাবার পরিবেশন করা হয়। যোগাযোগশৈলী ও নেতৃত্ব বিকাশে এখানে শিক্ষার্থীদের বিশেষ যত্ন নেওয়া হয়। বর্তমানে ১২৫ জন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ৪৩ জন। রয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুমের সুবিধা। আইসিটি ল্যাব ও সমৃদ্ধ পাঠাগার নিয়মিত ব্যবহার করা শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক।
প্রায় ২০০ একর জায়গার ওপর কেবল ছাত্রদের জন্য প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে ছোট-বড় আটটি টিলা রয়েছে, যার ছয়টিতেই রয়েছে চা-বাগান। তিনটি ফুটবল মাঠ, একটি ক্রিকেট মাঠ ও তিনটি ভলিবল মাঠের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ খেলাধুলারও সুযোগ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে মাছের খামার, সবজিবাগান ও পোলট্রি খামার স্থাপন করা হয়েছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয়। ইংরেজি স্পোকেন, বিজ্ঞান ও বিতর্কচর্চা থেকে শুরু করে মানবিক ও আদর্শ মানুষ হওয়ার কলাকৌশল নিয়ে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের নিয়মিত নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি এবং একাদশ শ্রেণি তো রয়েছেই, আসছে সেশনে এখানে নবম শ্রেণির ছাত্রদেরও ভর্তি করা হবে।
একাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. মামুনুর রশীদ গত বছর জৈন্তাপুর সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে এখানে ভর্তি হয়েছে। সে বলে, ‘এই কলেজের উন্নত পরিবেশ দেখে এখানে আমার ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়। পড়াশোনার পাশাপাশি সহশিক্ষা কার্যক্রমও আমাদের করতে হয়। এখন থেকেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তুতি নিতে উৎসাহিত করে আলাদা ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। আবাসিক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আমাদের সময়কে রুটিনমাফিক কাজে লাগানো হচ্ছে।’ একই শ্রেণির ছাত্র তারেক আহমেদের বাড়ি সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার নোয়াগ্রাম কামালগঞ্জে। ২০১৮ সালে সিলেট নগরের বাংলাদেশ ব্যাংক স্কুল থেকে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়ে সে এখানে ভর্তি হয়েছে। তারেক বলে, অসাধারণ পরিবেশ। যেমন প্রাকৃতিক, তেমনই মানসম্মত পড়াশোনা।
জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুলের বাংলা বিষয়ের প্রভাষক এমরাজ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে বিশ্বমানের পড়াশোনার মান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে জাতিকে সৎ, মেধাবী ও নেতৃত্ব গুণসম্পন্ন শিক্ষার্থী গড়ে তোলার উদ্দেশ্য থেকেই প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ ছাড়া বিদেশি শিক্ষার্থীরাও যেন আমাদের এই স্কুলে পড়াশোনা করতে পারে, সে সুযোগ নিশ্চিত করাও অন্যতম উদ্দেশ্য। ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি ঘিরে শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অভিভাবকদের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখানে ছাত্রদের ভর্তি ফি ও মাসিক বেতনও সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। এ ছাড়া মেধাবীদের ভর্তির ক্ষেত্রে রয়েছে বিশেষ ছাড়। ভালো ফলের পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীকে ভালো মানুষ হওয়ার সব ধরনের গুণাবলি এখানে আয়ত্ত করতে সহায়তা করা হয়।’
অধ্যক্ষের কথা
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিশেষায়িত বোর্ডিং স্কুলের ধারণায় বিশ্বমানের শিক্ষার সুযোগ নিয়ে প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়েছে। এখানে প্রথাগত প্রাইভেট কোচিং ধারণার বাইরে গিয়ে ছাত্রদের সার্বক্ষণিক শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পাঠ্যপুস্তকের পাশাপাশি সহশিক্ষার দিকেও লক্ষ রাখা হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশ, খেলাধুলা ও পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের দিকে বেশি নজর দেওয়া হয়। আগামী সেশন থেকে দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ প্রদানের লক্ষ্যে ব্রিটিশ পাঠ্যক্রম চালু করা হবে। এতে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে কম খরচে সহজে পড়াশোনা করতে আসতে পারবে।
বি কে ভারদ্বাজ
অধ্যক্ষ
জাফলং ভ্যালি বোর্ডিং স্কুল