পৃথিবীর উচ্চতম ও ভয়ংকর ছয়টি রেলপথ
ট্রেনভ্রমণ আমাদের অনেকের কাছে খুবই আনন্দদায়ক। ট্রেনভ্রমণকে নিরাপদ হিসেবে ধরে নেওয়া হয় পুরো পৃথিবীতে। কিন্তু বিশ্বে এমন কিছু রেলওয়ে ট্র্যাক বা রেলওয়ে ব্রিজ রয়েছে, যেগুলো ভ্রমণের জন্য শুধু বিপজ্জনক নয়, ভয়ংকরও বটে। এ রকম শ্বাসরুদ্ধকর ছয়টি রেলপথের কথা তুলে ধরা হলো:
ট্রেন এ লাস নুবেস, আর্জেন্টিনা
বিপজ্জনক রেলপথের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে আর্জেন্টিনার সালতা প্রদেশের ট্রেন এ লাস নুবেসের কথা। আন্দিজ পর্বতমালা দিয়ে প্রায় ২১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ উত্তর-পশ্চিম আর্জেন্টিনা হয়ে চিলির সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। আমেরিকান ইঞ্জিনিয়ার রিচার্ড মউরি এ রেলপথের নকশা করেছিলেন। এটি নির্মাণ শুরু হয় ১৯২১ সালে এবং ২৭ বছর পর ১৯৪৮ সালে রেলপথটির নির্মাণের কাজ শেষ হয়। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু রেলপথগুলোর মধ্যে অন্যতম এই রেলপথ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪ হাজার ২২০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। উচ্চতার কারণে এটি তৈরি করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ট্রেন এ লাস নুবেস নির্মাণের সময় প্রায় ৪০০ জন শ্রমিক প্রাণ হারান। ব্রিজগুলোর নিচ থেকে ট্রেনের দিকে তাকালে মনে হয় এটি মেঘের ভেতর দিয়ে চলেছে। এ রকম দৃশ্যের জন্য এই রেলপথকে ‘ট্রেন টু ক্লাউডস’ বলে ডাকা হয়। এই রেলপথে আছে দুটি জিগজ্যাগ, ২৯টি ব্রিজ এবং ২১টি টানেল। এই জিগজ্যাগ, ব্রিজ, টানেলগুলো এ রেলপথকে করেছে ভয়ংকর। এই রেলপথ বেশি বিপজ্জনক হওয়ার আরেকটি অন্যতম কারণ আর্জেন্টিনার ঠান্ডা জলবায়ু। প্রবল হাওয়া এবং ঠান্ডায় এই পথে ট্রেনগুলোকে চলতে হয় অত্যন্ত সাবধানে। মুহূর্তের ভুলে যেকোনো জায়গায় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি। এ ছাড়া এই রেলপথের কিছু কিছু অংশ রয়েছে কাদামাটির ওপর। এ কারণে ট্রেন যেকোনো সময় পিছলে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। উচ্চতা, জিগজ্যাগ, ব্রিজ, টানেল এবং আবহাওয়ার প্রকৃতি বিবেচনায় এই রেলপথ পৃথিবীর বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে অন্যতম।
নরিজ দেল ডায়াবলো, ইকুয়েডর
বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে এরপরই বলতে হয় ইকুয়েডরের আন্দিজ পর্বত দিয়ে যাওয়া ‘নরিজ দেল ডায়াবলো’ রেলপথটির কথা। এই জায়গায় পাহাড়ের একটি অংশের আকৃতি মানুষের নাকের মতো এবং এর ওপর দিয়েই ঘুরেফিরে গেছে ভয়ংকর এই রেলপথ। তাই এটিকে শয়তানের নাক বা ডেভিলস নোস রেলওয়ে হিসেবে ডাকা হয়। এই রেলপথ মূলত তার জিগজ্যাগ এবং আঁকাবাঁকা রুটের জন্যই বিখ্যাত। পাহাড় কেটে এই রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর একদিকে রয়েছে আন্দিজ পর্বতের উঁচু দেয়াল আর অন্যদিকে রয়েছে সুগভীর খাদ। আর সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় নয় হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত সরু এ রেলপথের প্রতিটি মোড়ই অত্যন্ত বিপজ্জনক। তাই এই রেলপথের ট্রেনচালকদের খুবই অভিজ্ঞ হতে হয় এবং ট্রেনচালক বাছাই করার প্রক্রিয়াও খুব কঠিন হয়ে থাকে। খুব রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ছাড়া এ পথে যাওয়া ভয়ংকর অভিজ্ঞতাই বটে।
১৮৯৯ সালে নির্মাণকাজ শুরু হওয়া এই রেলপথের শিখরের উচ্চতা প্রায় ১১ হাজার ৮৪১ ফুট। এই রেলপথ নির্মাণের সময়ও অনেক শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। তুষারপাত ও অবক্ষয়ের কারণে একাধিকবার বন্ধ থাকা সত্ত্বেও রেলপথটি পর্যটকদের আকর্ষণ হিসেবে এখনো চালু রয়েছে।
ফেরোক্যারিল সেন্ট্রাল অ্যান্ডিনো, পেরু
পেরুর ‘ফেরোক্যারিল সেন্ট্রাল অ্যান্ডিনো’ রেলপথটি বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি ক্যালাওয়ের প্রশান্ত মহাসাগরীয় বন্দর এবং রাজধানী লিমাকে হুয়ানকায়ো ও সেরো দে পাসকোর সঙ্গে যোগ করে দিয়েছে। পেরুভিয়ান আন্দিজের দর্শনীয় ল্যান্ডস্কেপ দিয়ে চলা এই রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ১৮৭১ সালে পোলিশ ইঞ্জিনিয়ার আর্নেস্ট ম্যালিনোভস্কির তত্ত্বাবধানে। তার ৫ বছর পর ১৮৭৬ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়। প্রায় ৫৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬ হাজার ফুট উঁচুতে আন্দিজ পর্বতমালায় অবস্থিত। এই রেলপথে আছে মোট ৬১টি ব্রিজ এবং ৬৫টি টানেল। পাহাড় কেটে বানানো হয়েছে এই টানেলগুলো। ব্রিজ এবং টানেলগুলো অতিক্রম করার সময় মুহূর্তের ভুলে ঘটতে পারে দুর্ঘটনা এবং প্রাণহানি।
হোয়াইট পাস অ্যান্ড ইউকন রুট রেলওয়ে, যুক্তরাষ্ট্র
পৃথিবীর অন্যতম বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কায় অবস্থিত ‘হোয়াইট পাস অ্যান্ড ইউকন রুট রেলওয়ে’ অন্যতম। প্রায় ১৭২ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ ইউকনের রাজধানী হোয়াইট হর্সের সঙ্গে স্কাগওয়ে ও আলাস্কার বন্দরকে সংযুক্ত করেছে। তবে এই রেলপথ আর কোনো রেলপথের সঙ্গে যুক্ত নয়। মূলত ১৮৯৮ সালে সোনার খনি এলাকায় পৌঁছানোর জন্য রেলপথটি নির্মাণের কাজ শুরু হয় এবং পরবর্তী সময়ে ১৯০০ সালে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। পরবর্তী সময়ে রেলপথটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল। ১৯৮২ সালে দুর্ঘটনার কারণে রেলপথটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ১৯৮৮ সালে এটি আবার চালু করা হয়।
এই রেলপথের কিছু কিছু অংশ কাঠের তৈরি। তবে এই রেলপথটি বিপজ্জনক হওয়ার প্রধান কারণ এর একদিকে গভীর খাদ আর অন্যদিকে রয়েছে উঁচু পাহাড়। এই রেলপথে ট্রেনগুলোকে অনেকগুলো ছোট ছোট টানেল এবং উঁচু উঁচু ব্রিজের ওপর দিয়ে যেতে হয়। এই ব্রিজগুলোর কোনো কোনোটির উচ্চতা ৩ হাজার ফুটের বেশি। বরফের শীতল বাতাস আর অন্ধকার টানেলের কারণে এই রেলপথ আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।
কুম্ব্রেস অ্যান্ড টলটেক সিনিক রেলরোড, যুক্তরাষ্ট্র
বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে এরপর আসে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ মেক্সিকো থেকে কলোরাডো পর্যন্ত বিস্তৃত ‘কুম্ব্রেস অ্যান্ড টলটেক সিনিক রেলরোডে’র কথা। এটি অনেক পুরোনো একটি রেলপথ, যেটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে উঁচু ও সরু রেলওয়ে লাইনও বটে। প্রায় ৮০ কিলোমিটার লম্বা এবং ৩ ফুট চওড়া ন্যারোগেজ এই রেলপথ নির্মিত হয় ১৮৮০ সালে। রেলপথটি মূলত সান জুয়ান পর্বতমালার খনন কার্যক্রম সহজ করার জন্য তৈরি হয়েছিল। পরে ১৯৬০–এর দশক পর্যন্ত বিভিন্ন কৃষি ও শিল্পপণ্য পরিবহন করা হয় এই রেলপথ দিয়ে। ১৯৬৮ সালে এই রেলপথে পণ্য পরিবহন কার্যত বন্ধ হয়ে যায় এবং রেলপথটি পরিত্যাগের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তাই ১৯৭০ সালে কলোরাডো এবং নিউ মেক্সিকোর রাজ্য আন্তোনিটো এবং চামার মধ্যে প্রায় ৮ মাইল অংশ কিনে নেয় এবং ‘কুম্ব্রেস অ্যান্ড টলটেক সিনিক রেলরোড’ নামে এর যাত্রা শুরু করে।
এই রেলপথে ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১০৩ কিলোমিটার বেগে চলে। রেলপথটি প্রায় ১০ হাজার ফুট উঁচু। অনেক উঁচু হওয়ার কারণে এই রেলপথে কয়লা আর বাষ্পচালিত ট্রেন এখনো চালানো হয়ে থাকে।
জর্জটাউন লুপ রেলপথ, যুক্তরাষ্ট্র
বিপজ্জনক রেলপথগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলোরাডোর ক্লিয়ার ক্রিক কাউন্টির রকি পর্বতমালায় অবস্থিত ‘জর্জটাউন লুপ রেলপথ’। প্রায় ৭ দশমিক ২ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ পৃথিবীর সুন্দর রেলপথগুলোরও অন্যতম।
এই রেলপথের সবচেয়ে ভয়ংকর অংশটি হচ্ছে ডেভিলস গেট হাইব্রিজ। মাটি থেকে প্রায় ১৯৫ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই ব্রিজ। রেলপথটি ১৮৮৪ সালে নির্মাণ করা হয়। এরপর ১৮৯৯ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এই রেলপথ যাত্রীবাহী এবং মালবাহী দুই ধরনের ট্রেন চলাচলের জন্য ব্যবহার করা হতো। এরপর ১৯৩৯ সালে রেলপথটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পরে ১৯৮৪ সালে এর ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রেলপথটি আবার খুলে দেওয়া হয়।
এই ছয় রেলপথ ছাড়াও পৃথিবীতে আরও কিছু ভয়ংকর রেলপথ রয়েছে। এই রেলপথগুলোতে চলাচল করলেই কেবল এগুলোর ভয়ংকর সৌন্দর্য অনুভব করা যায়।
সূত্র: বিভিন্ন ওয়েবসাইট