পাবনা স্টেশনে একবেলা

পাবনা রেলওয়ে স্টেশন। ছবি: হাসান মাহমুদ
পাবনা রেলওয়ে স্টেশন। ছবি: হাসান মাহমুদ
>

পাবনা রেলওয়ে স্টেশন গত মাসেই আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়েছে। একেবারে ঘরের উঠোনে রেলসংযোগ পেয়ে জেলা সদরের মানুষ যেন উৎসবে মেতেছেন। প্রয়োজনে তো বটেই, অনেকে স্টেশনে আসছেন ঘুরতেও। এই ঘুরিয়েদের কেউ কেউ আবার টিকিট কেটে শখের বসে উঠে বসছেন ট্রেনে।

চারপাশে সবুজ গ্রাম। মাঝখানে বিশাল এলাকাজুড়ে পাবনা রেলওয়ে স্টেশন। স্টেশন এলাকাটি পড়েছে জেলা সদরের লস্করপুরে। যেদিকে চোখ যায়, সব নতুন নতুন স্থাপনা। সাজানো-গোছানো। মনোরম পরিবেশ বলতে যা বোঝায়, ঠিক যেন তা-ই। স্টেশনের প্রধান ফটক থেকে পরিপাটি প্রশস্ত পথটা ভেতরে চলে গেছে। পথের দুপাশে সুন্দর বাগানে মৌসুমি ফুল ফুটেছে। আছে কিছু ফলের গাছও। এগিয়ে যাই ওই পথ ধরে।

প্ল্যাটফর্মে পা রাখতেই একরাশ শূন্যতা ভর করল। এই শূন্যতা ট্রেনের জন্য। পরিপাটি স্টেশনে তখন কোনো ট্রেন নেই। একদম ফাঁকা। তবে দর্শনার্থী আর আগাম টিকিট কিনতে আসা যাত্রীদের আনাগোনা ছিল চোখে পড়ার মতো। অনেকে বসে আছেন প্ল্যাটফর্মঘেঁষা বেঞ্চে। পুরো স্টেশন এলাকা এক নজরে দেখার জন্য অনেকে উঠে বসেছেন ফুটওভারব্রিজে। তাঁদের কেউ কেউ এসেছেন দল বেঁধে। কথা হয় এমনই কয়েকজন যাত্রী ও দর্শনার্থীর সঙ্গে।

পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছিলেন পাবনা সরকারি মহিলা কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল খালেক। তিনি বলছিলেন, ‘আগে ট্রেনে ভ্রমণের জন্য ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরের ঈশ্বরদী কিংবা চাটমোহর স্টেশনে যেতে হতো। অনেক বিপত্তির ব্যাপার ছিল। বহুদিনের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে এখন। তাই ভালো লাগাটা একটু অন্য রকম।’

তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে এগোই। রোদের উত্তাপ কমছিল। সন্ধ্যা জেঁকে বসছিল। সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছিল মানুষের ভিড়। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ, নানা বয়সী মানুষে পরিপূর্ণ তখন প্ল্যাটফর্ম। তবে তাঁদের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা নয়। নতুন স্টেশনে ঘুরে বেড়ানো, খাওয়াদাওয়া আর মুঠোফোনে সেলফি তোলাই উদ্দেশ্য।

উদ্বোধনের দিন এমন বর্ণিল করেই সাজানো হয়েছিল পাবনা এক্সপ্রেস
উদ্বোধনের দিন এমন বর্ণিল করেই সাজানো হয়েছিল পাবনা এক্সপ্রেস

কথা হলো পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী ইশরাত জাহানের সঙ্গে। স্টেশন চালুর আগে কখনোই ট্রেনে ভ্রমণের সুযোগ পাননি। পাবনা স্টেশন নির্মাণ শুরু হওয়ার পর থেকে কয়েকবার স্টেশনে ঘুরতে এসেছেন। এরপর রেলযাত্রা শুরুর পর প্রথম রেল ভ্রমণ করেছেন। বললেন, ‘বেশ রোমাঞ্চকর ছিল সে অনুভূতি।’

বছরখানেক হলো এমন দৃশ্য এখানে নিয়মিত। তখন সবে স্টেশনের কাজ শুরু হয়েছে। সেই থেকেই অনেক পাবনাবাসীর বিকেল কাটছে স্টেশনে। শত শত মানুষের আনাগোনায় স্টেশন ঘিরে শুরু হয়েছে নতুন নতুন ব্যবসা। ফুচকা, চটপটি থেকে শুরু করে বাদাম, আমড়া, পেয়ারা এমনকি কোমল পানীয়র দোকান সাজিয়ে বসছেন অনেকে। 

আসকার শেখের দেখানো পথে
কিছুদিন আগেও স্টেশনের একমাত্র বাদাম বিক্রেতা ছিলেন আসকার শেখ। এখন তাঁর মতো অনেকেই ডালিভর্তি বাদাম নিয়ে এসেছেন। আসকার শেখের বয়স ৭৫ বছর। বাড়ি লস্করপুরেই। আগে রিকশা চালাতেন। বয়সের ভারে এখন রিকশা চালাতে কষ্ট হয়। তাই স্টেশনের নির্মাণযজ্ঞ শুরু হলে পেশা বদলান। যেমনটি তিনি বলছিলেন, ‘এই বয়সে শক্ত কাজ করতে পারি না বাবা। স্টেশনের কাজ শুরু হলে আমিই প্রথম বাদাম বিক্রি শুরু করছি।’

দিনে দিনে লোকজনের আনাগোনা বৃদ্ধিতে ব্যবসাটাও বেশ জমে উঠেছে তাঁর। প্রতিদিন ১৫০-২০০ টাকা আয় হয়। তবে শুক্রবার আর উৎসবের দিনগুলোতে বিক্রি বেশি হয়।

স্টেশনে শুধু আসকার শেখ নন। তাঁকে অনুসরণ করে অনেকেই ব্যবসা খুলে বসেছেন স্টেশনে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তরুণ, বৃদ্ধ এমনকি নারীরাও। চাকরিজীবনের অবসরগ্রহণের পর বেকার বসে ছিলেন শালগাড়িয়া মহল্লার ৭০ বছর বয়সী আফজাল হোসেন। ঘরে বসে সময় কাটত না। একটা কাজ খুঁজছিলেন। স্টেশন চালুর পর শরবতের দোকান করেছেন। বেশ ভালো বেচাকেনা চলছে, সময়টাও কেটে যাচ্ছে। ফলে তিনি খুবই খুশি।

বন্যা খাতুন গৃহিণী। স্বামীর আয়ে সংসার চলে না। আগে মানুষের বাড়িতে কাজ করতেন। স্বামী সংসার সামলে ঠিকমতো কাজ করতে পারতেন না। তাই এখন স্টেশনে স্বাধীন ব্যবসা করছেন। ৩৫ বছর বয়সী বন্যা খাতুন বাড়ি থেকে নিমকি, পিঁয়াজি, কুড়মুড় খাস্তা তৈরি করে স্টেশনে এনে বিক্রি করেন। যা আয় হয় তাতে ভালোই চলছে তাঁর সংসার।

আসকার শেখ
আসকার শেখ

আসকার শেখ, আফজাল হোসেন, বন্যা খাতুনের মতো চা-কফি, ঝালমুড়ি এমনি ছোটদের খেলনার দোকানিদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই রাত আটটা বেজে যায়। দর্শনার্থীদের আনাগোনা কমতে থাকে। ভিড় বাড়ে প্রিয়জনের প্রতীক্ষায় থাকা মানুষের। একটু পরই ট্রেন আসবে, ঘরে ফেরা মানুষের পদচারণে প্রাণ পাবে প্ল্যাটফর্ম, নিয়ন আলোয় আনন্দ খেলে যাবে প্রতীক্ষিত মানুষের মুখে। স্টেশনের চিরচেনা সেসব দৃশ্য কল্পনা করতে করতেই ছেড়ে আসি পাবনা রেলওয়ে স্টেশন। 

অতঃপর পাবনা এক্সপ্রেস
রেল নিয়ে পাবনা শহরবাসীর স্বপ্ন বহুদিনের। স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে তৎকালীন সরকার ঈশ্বরদী থেকে পাবনা হয়ে নগরবাড়ি পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। সে অনুযায়ী ঈশ্বরদী ও নাটোরের লালপুর উপজেলার মাঝগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের ফলে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৯ সালে প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। ভেস্তে যায় পাবনাবাসীর রেলস্বপ্ন।

দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে প্রকল্পটির কাজ শুরু করে। প্রকল্পর পরিধি বাড়িয়ে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা জেলা সদর হয়ে জেলার বেড়া উপজেলার ঢালারচর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হয়।

২০১৩ সালের ২ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে এক জনসভায় এই রেলপথ নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। চার দফা সময় বাড়িয়ে তৈরি হয় মাঝগ্রাম থেকে পাবনা পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার রেলপথ। গত ১৪ জুলাই পাবনা পুলিশ লাইন মাঠ থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন এ রেলপথে ‘পাবনা এক্সপ্রেস’ নামে একটি ট্রেনের চলাচল উদ্বোধন করেন। স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয় পাবনাবাসীর। এরপর থেকে সপ্তাহে ছয় দিন ট্রেনটি পাবনা-রাজশাহী রুটে চলাচল করছে।