পরীক্ষার ভয় অনেক শিক্ষার্থীকেই কাবু করে ফেলে। ভয়ে অনেকের সারা রাত ঘুম হয় না। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে। বসে বসে দুশ্চিন্তা করেই সময় পার করে দেয়, পড়ায় আর মন বসাতে পারে না, এমন কারও কারও কথাও শুনেছি।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্রকৌশল বিভাগে আমি ছাত্রছাত্রীদের পড়াই। কিছুদিন আগেই আমি নিজেও স্নাতকোত্তরে লিখিত পরীক্ষা দিয়েছি। অতএব পরীক্ষার্থী এবং পরীক্ষক—দুই ভূমিকাতেই অভিজ্ঞতা এখনো টাটকা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পরীক্ষাভীতি সম্পর্কে দু-একটা কথা বলতে পারি।
সারা বছর পড়ালেখা না করে পরীক্ষার আগে যদি কেউ বই খুলে বসে, তাহলে ভয় পাওয়া খুব স্বাভাবিক। অতএব ভয় পেতে না চাইলে আগে থেকেই একটু একটু করে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। নইলে পরীক্ষার আগের রাতে মাথায় তো আকাশ ভেঙে পড়বেই। আমার যেটুকু প্রস্তুতি নেওয়া দরকার সেটুকু নেব, ঘাবড়ে না গিয়ে পরীক্ষার হলে ততটুকুই লিখব—এভাবে নিজেকে বোঝাতে পারলে পরীক্ষা দেওয়া সহজ হয়।
বিরতিহীনভাবে পড়ালেখা করাও বোকামি। পরীক্ষার আগে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে। পড়ার ফাঁকে একটু একটু বিশ্রাম নেওয়া, বিরতি নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। একনাগাড়ে পড়তে থাকলে মনের ওপর, মাথার ওপর চাপ পড়ে।
স্কুল-কলেজের পড়ালেখার তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া বেশ আলাদা। একটা বয়স পর্যন্ত স্কুল-কলেজ ঘিরেই জীবন আবর্তিত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঠার পর ছেলেমেয়েদের বিশ্বটা হয়ে যায় অনেক বড়। ব্যাপারটা অনেকটা পড়ালেখার সিলেবাসের মতোই। আমাদের স্কুল-কলেজে একটা নির্দিষ্ট সিলেবাস থাকে। শিক্ষকদের, মা-বাবার শাসন থাকে। নিয়মিত পড়ালেখা করার চাপ থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার কোনো নির্দিষ্ট সিলেবাস নেই। পড়ার ব্যাপ্তিটা হয়ে যায় অনেক বড়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এবং পড়ানোর অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়, এ ক্ষেত্রে ‘গ্রুপ স্টাডি’ খুব প্রয়োজন। বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে বসে সমস্যাগুলোর সমাধান করলে প্রস্তুতিটা ভালো হয়। একজনের ভুলগুলো অন্যজন শুধরে দিতে পারে।
অনেক সময় মনে হতে পারে, আমার বন্ধুরা তো সব পারে, আমিই বোধ হয় পিছিয়ে আছি—এভাবে ভাবলে ভুল হবে। আমার প্রস্তুতি আমি আমার মতো করে নেব। আরেকজন তার মতো করে প্রস্তুতি নেবে। আমরা মিলেমিশে দুর্বলতাগুলো দূর করতে চেষ্টা করব। কিন্তু আরেকজন কী পড়ছে, আমিও তার দেখাদেখি পড়ব, এভাবে প্রস্তুতি নেওয়া ঠিক নয়।
এখন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা চলছে। এই সময়টা শিক্ষার্থীদের জন্য খুব কঠিন। মা-বাবা, স্বজনদের প্রত্যাশার চাপে মনের মধ্যে ভয় জেঁকে ধরে। যদি চান্স না পাই! যদি মা-বাবার ইচ্ছে পূরণ করতে না পারি। উচ্চমাধ্যমিক পেরোনোর পর আমাকেও বাসা থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেই হবে। স্পৃহা ছিল, আত্মবিশ্বাস ছিল, নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ ছিল, তাই ভয় পাইনি। আমি মনে করি, নেতিবাচক চিন্তা না করে নিজের সেরাটা দেওয়ার প্রতিই জোর দেওয়া উচিত।
পরীক্ষাভীতি দূর করার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারেন শিক্ষকেরা। পড়তে বসে ছাত্রছাত্রীরা অনেক সময় বিভ্রান্ত হয়ে যায়। শিক্ষকদের সহায়তা এই সময় খুব জরুরি। ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা মাথায় রাখি। আমার দরজা ছাত্রছাত্রীদের জন্য সব সময় খোলা। আমার ফোন নম্বর, ই-মেইল ঠিকানা শিক্ষার্থীদের কাছে আছে। যেকোনো সমস্যায় তারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।
লেখক: প্রভাষক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়