আজ আমি এখানে দাঁড়িয়েছি প্রথমত একজন মা হিসেবে। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি আপনাদের মতো আমিও তরুণ। একটা পাগলামি আছে আমার মধ্যে। তৃতীয়ত, আমি একজন উদ্যোক্তা। আপনারা খুব অস্থির। তাই খুব বেশি কথা বলব না, শুধু কয়েকটা কথা বলতে চাই।
প্রথমেই বলি, কজন মা-বাবার কাছে সত্যি কথা বলেন? হাত তোলেন তো।...বাহ, খুব সুন্দর। অনেকেই তো! তাহলে বলতে পারেন আপনি অর্ধেক পথ পাড়ি দিয়ে ফেলেছেন।
নানা রকম সাফল্যের কথা হচ্ছিল। সেই সূত্র ধরেই বলি, আমার স্বামী আনিসুল হক ৮ মাইল হেঁটে স্কুলে যেতেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন তিনি। তারপর দেশ গ্রুপে চাকরি নিয়েছিলেন। সেখানে ট্রাকের পেছনে উঠে মাল নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে যেতেন। এই হলো আনিসের শুরু। আর আমার শুরু হলো, ১৫ বছর বয়স থেকে টিউশনি করতাম। বাবা অবসর নেবেন, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবেন, নানা রকম চিন্তা ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ আমি। পড়ার জন্য কখনো বিদেশে যেতে পারিনি। পরে অবশ্য বাইরে থেকে পিএইচডি করেছি। কাজেই দেশ-বিদেশ আমাদের বাধে না। আমাদের সম্পদ আমাদের কখনোই সীমিত করে না। যেটা আমাদের বড় করে সেটা হলো স্বপ্ন, আমাদের ভেতরের ইচ্ছা। এটা মনে রাখতে হবে।
আমরা কে কত বড়লোক তাতে কিন্তু কিচ্ছু যায় আসে না। বিত্ত এবং ক্ষমতা—আমাদের আসলে আবার নতুন করে এই দুটি শব্দের সংজ্ঞা বেঁধে দিতে হবে। যে বড়লোক সে-ই বড় না। যে বিত্তশালী সে-ই সাংঘাতিকভাবে ক্ষমতার অধিকারী না। অনেক সময় কিন্তু সম্পদ আমাদের খাটোও করে দেয়। এটাও মাথায় রাখতে হবে। তার মানে এই না যে আমরা মনের দিক থেকে কোনো দৈন্যের মধ্যে পড়ব। মনের দৈন্য যেন কখনো আমাদের না থাকে।
আমি তিন সন্তানের মা। আমার বড় ছেলের বয়স ৩৬। মেজ মেয়ের বয়স ৩৩। একদম ছোটটি সাতাশে পড়বে। কাজেই আপনারা...তুমি বলি, তোমরা সবাই আমার অনেক ছোট। সবাই আমার সন্তানতুল্য। মা-বাবাকে মিথ্যা বলে কিন্তু বেশি দূর যাওয়া যায় না। মা-বাবা সব সময়ই হয়তো যা-ই করতে যাবেন, প্রথমেই বলবেন এটা না করলে হয় না? কিংবা তুমি এটা করে সময় নষ্ট করছ। কিন্তু, বোঝাতে হবে। বারবার বসতে হবে। আদর করতে হবে। জড়িয়ে ধরতে হবে। মা-বাবার সঙ্গে যেন কখনো দূরত্ব তৈরি না হয়। রুমের মধ্যে কখনো বন্দী হয়ে থাকবে না।
পরিবার একটা বিরাট বড় শক্তি। হ্যাঁ বন্ধুরা নিশ্চয়ই অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের ওপর বন্ধুদের অনেক রকম প্রভাব আছে। কিন্তু পরিবার খুব জরুরি। পরিবারকে ছেড়ো না। পরিবারকে ছাড়লে অন্য অনেক কিছুতে মানুষ সংযুক্ত হয়ে যায়। অনেক সময় নেশায় আসক্ত হয়। মাদকে আসক্ত হয়। পরিবারকে যেকোনো সময়, যেকোনোভাবেই বোঝানো যায়। না হলে বন্ধুবান্ধবের সাহায্য নেবে। আত্মীয়স্বজনের সাহায্য নেবে। কিন্তু মা-বাবা এবং ভাইবোনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করবে না। এটা সবচেয়ে বেশি জরুরি।
একটু আগে একটা ভিডিও দেখছিলাম। ভিডিওতে অনেকগুলো মুখ আমার চেনা। যারা খুব ছোট, তাদের হয়তো চিনি না। কিন্তু যাদের চিনি, তারা আমার আইডল। আমি মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো একজন শিক্ষক হতে চাই। স্থপতি ইকবাল হাবীবের মতো একজন বন্ধু হতে চাই। হুসেইন মো. ইলিয়াসের মতো একজন তরুণ উদ্যোক্তা হতে চাই। খোলা মাঠ দেখে এখনো মনে হয়, কিছু একটা খেলি। বহু বছর আগে কখনো টেনিস আর স্কোয়াশ খেলতাম। এরপর আর খেলা হয়নি। এখন টেবিল টেনিস খুঁজে বেড়াই যে কোথায় গেলে টেবিল টেনিস খেলতে পারব। মুনির হাসানের মতো লোককে দেখলে মনে হয়, আরে এ তো সাংঘাতিক মেন্টর। ওর মতো হতে চাই। কাজেই আজ ওই ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তাদের সবার মতো আমি হতে চাই। মতিউর রহমানের মতো একজন সম্পাদক হতে চাই। আনিসুল হকের মতো ভালো লিখতে চাই। চাওয়ার কোনো শেষ নেই। আমার আগের বক্তা বলে গেলেন যে সময় ব্যবস্থাপনা খুব দরকার। মাথার ভেতরেই সময় ভাগ করে ফেলতে হবে।
‘মাল্টিটাস্কিং’ আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে, সব একসঙ্গে করতে হয়। কাজেই আমি কবিতা লিখি। কাজেই আমি গান শুনি। কাজেই আমি বই পড়ি। কাজেই আমি অফিসে পাগলের মতো দৌড়াই। কাজেই আমি চেষ্টা করি পড়াশোনা করে পিএইচডিটা করতে। সব করেছি।
তারুণ্য এমন একটা জিনিস, এটা সব সময় আমাদের তাড়া করে ফেরে। হৃদয়ে তরুণ না হলে আমরা কিন্তু কখনোই এগোতে পারব না। আরেকটা জিনিস মনে রাখতে হবে—উদ্যোক্তা হতে চাও খুব ভালো। ঝুঁকি নিতে হবে। নিতেই হবে। তোমাদের নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কোনো কারণ নেই। তোমাদের নিরাপত্তাহীনতার জায়গাটা আমরা অনেকটা দূর করে দিয়েছি। আমরা মা-বাবারা তোমাদের অনেকগুলো দায়িত্ব পালন করে দিয়েছি। থাকাখাওয়ার চিন্তা তোমাদের অনেকের নেই। আর যদি চিন্তা করতেও হয়, তা-ও সংগ্রামের মধ্যেও একটা আনন্দ আছে। সংগ্রাম করতেই হবে। শর্টকাট নেই।
তোমাদের প্রজন্মের প্রতি আমার একটাই অভিযোগ, তোমরা আসলে ‘শর্টকাট প্রজন্ম’। ‘শর্টকাট প্রজন্ম’ আর ‘ধুর প্রজন্ম’। কথায় কথায়, ‘ধুর’। কেমন আছ? ‘ধুর!’ কী করছ? ‘ধুর!’ এই দুটো বন্ধ করতে হবে। তোমাকে অবশ্যই জীবনে আশাবাদী হতে হবে। জীবন অসীম। সময় অসীম। সময়কে তুমি বাঁধবে তোমার ইচ্ছেমতো, তোমার প্রয়োজনমতো। ‘সময় নেই’ এই কথাটা বলবে না। সময় সব সময় আছে।
তোমরা কেন আমাদের কারখানায় এসে দেখছ না, লাইনগুলোতে কী নতুন জিনিস করা যায়। কী নতুন উদ্ভাবন করা যায়। আমাদের ‘প্রোডাকশন লাইন’ কি সারা জীবন একই রকম থাকবে? চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে কথা হচ্ছিল। এরপর আমরা কোথায় যাব? আমার ৩০ লাখ শ্রমিক কোথায় যাবে? এদের তো সেই শিক্ষা নেই, এরা তো অবান্তর হয়ে যাবে। কিন্তু তোমরা প্রাসঙ্গিক হবে। তারুণ্য সব সময় প্রাসঙ্গিক হবে। আমাদের জায়গা দখল করবে তোমরা। কাজেই তোমরা খুঁজে দেখো, কী করতে চাও।
আমার যত সহকর্মী আছেন, আমি প্রত্যেককে বলব তোমাদের এই সুযোগটা দিতে। অন্তত ৫০টি কারখানাও যদি তোমরা ঘুরে দেখতে পারো, ঢুকে দেখো যে আমরা কী ধরনের কাজ করি এবং কোথায় অটোমেশন সম্ভব। দোখো না মাথায় কিছু আসে কি না, যাতে করে আমাদের মানুষগুলোর চাকরি যাবে না, আবার অটোমেশনের দিকেও আমরা এগিয়ে যাব। আমি বড় বড় সমাধান বিদেশ থেকে কিনতে চাই না। আমার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার বিদেশ থেকে কেনার দরকার নেই। তোমরা যথেষ্ট। তোমাদের মাথা যথেষ্ট। কাজেই আমি একটা উদ্ভাবনী চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চাই তোমাদের জন্য। পুরস্কার দেওয়ার কথায় আমরা খুব কৃপণ হব না, এটুকু আশ্বাস দিতে পারি।
তোমরা যদি পারো, তাহলে পাঠাওয়ের ইলিয়াসের মতো একটা অদ্ভুত আইডিয়া হাজির করো। আমাদের শিল্প খাতটা যেন পরিত্রাণ পায়। ৩০ লাখ শ্রমিক রাতারাতি কোডিং শিখে ফেলবে না। এদের সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। এস্তোনিয়ায় একেবারে ছোটবেলা থেকে গণিত আর কোডিং শেখায়। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কিন্তু সেটা হয় না। আমি আজ প্রথম আলোর মাধ্যমে সবাইকে বলতে চাই, আমরা যদি আদতেই আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে চাই, তাহলে একদম ক্লাস ওয়ান থেকে গণিত আর কোডিংয়ের ওপর জোর দিতে হবে।
পাশে আছি তোমাদের। সব সময় থাকব। কারণ তারুণ্য কখনোই ছুড়ে ফেলে দেওয়ার মতো না। কারণ তারুণ্যে হতাশা থাকতে পারে, কিন্তু তারুণ্য আবার নিজের শক্তিতেই জ্বলে ওঠে। সব সময় মনে রাখবে, যখনই সকালে উঠে খারাপ লাগবে, বাইরে থেকে হেঁটে আসো। দৌড়ে আসো। ব্যায়াম করো। মনে রাখতে হবে, তোমাদের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর যোগাযোগ করো আমাদের সঙ্গে। তারুণ্য আমাদের কাছাকাছি আসবে। আমরা সারাক্ষণ পাশাপাশি কাজ করব। এই আশায় রইলাম।