পরিবর্তনের জন্য সাহসী হতে হবে
প্রখ্যাত নাগরিক অধিকারকর্মী ও কবি মায়া অ্যাঞ্জেলো বলেছিলেন, ‘তোমার যা প্রয়োজন, তা দাবি করো এবং তা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকো।’ তাঁর এই উক্তি থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি যে, ‘পরিবর্তন দাবি করার জন্য সাহসী হতে হয়’। এর সূত্র ধরেই এই বছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘পরিবর্তনের জন্য সাহসী হও’। বাংলাদেশের মেয়ে ও নারীদের কোন কোন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসতে হবে এবং পরিবর্তনের জন্য কোথা থেকে তারা সাহসটা পাবে সেটা চিহ্নিত করার সময় এখনই।
পরিবর্তন-১: মেয়েদের জন্য বিনিয়োগ
বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম জনবহুল রাষ্ট্র। জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) ডেমোগ্রাফিক ইমপ্যাক্ট স্টাডি-২০১৫ অনুসারে, ২০২১ সালের মধ্যে দেশে জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৭ কোটিতে, যাদের ২০ শতাংশেরও বেশির বয়স থাকবে ১০ থেকে ১৯ বছরের কোটায়। যেসব জেন্ডার (সামাজিক) রীতিনীতি ও চর্চা কিশোরীদের অধিকার লঙ্ঘন করে,নারীর প্রতি সহিংসতাকে বাড়ায় এবং তাদের অথনৈতিক উন্নয়ন,স্বাস্থ্য ও সামগ্রিক কল্যাণকে বাধাগ্রস্ত করে সেগুলোকে চিহ্নিত করাই এখন বাংলাদেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। গবেষণা থেকে দেখা গেছে যে নারীর প্রতি সহিংসতাকে ‘রীতি’ হিসেবে মার্জনা করা হয়। কিন্তু এ ধারা চলতেই থাকবে যদি না ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই নারী–পুরুষের বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়টি পরিবার বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে জানানো হয় এবং পরিবারে নারী–পুরুষের সমতার িবষয়টি চর্চা হয় (আইসিডিডিআরবি, ২০১১)। এই ক্ষেত্রে উল্লেখ্য যে, আমাদের দেশে কিশোর–কিশোরীরা পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক এবং সামাজিক গঠনমূলক মনোভাব ও নাগরিক জ্ঞান অর্জনের সুযোগ পায় না। অথচ এই ধরনের দক্ষতা অর্জন করাটা ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন ও কর্মক্ষেত্রের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিশোর-কিশোরীদের যৌন, প্রজনন শিক্ষাসহ জীবনমুখী দক্ষতাগুলো শেখানো প্রয়োজন। এর ফলে সঠিক বয়সেই তাদের মধ্যে শ্রদ্ধা, সহিষ্ণুতা ও অনুধাবনের মূল্যবোধ গড়ে উঠবে।
বাংলাদেশকে জনমিতিক সুফল পেতে হলে কিশোর-কিশোরীদের জন্য বিনিয়োগ করতে হবে্। নারীর জীবনমান উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে বিশেষ করে কিশোরীদের জন্য বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। এই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও জীবনমুখী দক্ষতাগুলোর উন্নয়নের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে, যা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়োগ-যোগ্যতাও বৃদ্ধি করবে। আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষায় জেন্ডার সংবেদনশীল মডিউল ও জীবনমুখী দক্ষতাগুলো প্রবর্তন করার লক্ষ্যে ইউএনএফপিএ সহযোগী সংস্থাগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। এই কর্মসূচির লক্ষ্য হচ্ছে আজকের কিশোর–কিশোরীদের দায়িত্ববান,অহিংস ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হিসেবে গড়ে তোলা, যাতে তারা সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত জীবনযাপন করতে পারে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ করার জন্য তাদেরকে যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কে তথ্য জানানো হয়।
পরিবর্তন-২: বাল্যবিবাহ বন্ধ করা এবং মেয়েদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা
বাল্যবিবাহের হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের মেয়েদের অবস্থান অন্যতম শীর্ষে। এখানে বাল্যবিবাহের পেছনের অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে: দারিদ্র্য, বাবা-মায়েদের তাদের মেয়েদের ক্ষতি ও যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করার আকাঙ্ক্ষা, গতানুগতিক কতগুলো চর্চা যেমন, যৌতুক, নারীদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রচলিত বিশ্বাস এবং সর্বোপরি এগুলো ধরে রাখার ইচ্ছা। দেশে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৫৯ শতাংশেরই ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে হয় (বাংলাদেশ খানা জরিপ-২০১৪)। এর মাধ্যমে মেয়েদের কাছ থেকে তাদের শৈশব ছিনিয়ে নেওয়া হয় এবং তাদের শিক্ষা, আয়ের সুযোগ, সামাজিক যোগাযোগ ও সহায়তাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বাধাগ্রস্ত হয়। কোনো মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হলে তার পড়ালেখা বন্ধ হয় এবং অল্প বয়সে মা হয়। এতে তার নিজের ও সন্তানের স্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে। অল্প বয়সে বিয়ে,একাধিক গর্ভধারণ এবং সন্তান ধারণের উচ্চ হার এই বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে আসছে যে, মেয়েদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে এবং জীবনমুখী দক্ষতা শেখাতে হবে। এ জন্য বিয়ের বয়স বাড়াতে হবে এবং যথাযথ পরিবার পরিকল্পনার মাধ্যমে সন্তানধারণের িবষয়টিকে বিলিম্বত করতে হবে।
আমাদের দেশে মেয়েদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া, বিয়ের পরপরই তাদেরকে গর্ভধারণে জোর করা বা বাধ্য করা এবং তাদের ওপর নির্যাতন চালানো– এসব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিগুলো পরিবর্তন করা খুব প্রয়োজন। আচরণের এই পরিবর্তনগুলো ঘটাতে হবে সামাজিক পর্যায়ে। এর ফলে কিশোর–কিশোরীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে বুঝতে পারবে এবং তাদের পছন্দ অপছন্দের বিষয়গুলো প্রকাশ করতে পারবে।
কিশোরীদের স্বাস্থ্য ও ভবিষ্যৎ; সর্বোপরি দেশের ভবিষ্যতের ওপর বাল্যবিবাহের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য ইউএনএফপিএ বৈশ্বিক ও জাতীয় কর্মসূচির মাধ্যমে কাজ করছে। মেয়েদের সুরক্ষার জন্য নীতি ও আইনের কার্যকরী বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে ইউএনএফপিএ ও সহযোগীরা সরকারকে সহায়তা করা অব্যাহত রাখবে।
পরিবর্তন-৩: মেয়ে ও নারীদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা
বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার জন্য সরকারকে আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণের নিম্ন হারের িবষয়টিতে নজর দিতে হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে মাত্র ৩৬ শতাংশ নারী আনুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে রয়েছে। ফলে প্রবৃদ্ধি ও উদ্ভাবনের একটি অপার সম্ভাবনা থেকে দেশের অর্থনীতি বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষত, দরিদ্র পরিবারগুলোতে নারীর অবস্থান নিচে হওয়ায় তাদের সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগছে না এবং এসব পরিবারের আয় বাড়ছে না। শ্রমবাজারে নারীদের কম অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে নারীদের কর্মসংস্থানের প্রতি চিরাচরিত দৃষ্টিভঙ্গি, নিম্ন মানের কর্মপরিবেশ, যৌন নিপীড়ন ও বেতনবৈষম্যের মতো বিষয়গুলোকে চিহ্নিত করা হয়।
শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে বাজারে চাহিদা আছে এমন দক্ষতার উন্নয়ন, কর্মপরিবেশের উন্নয়ন এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার জন্য সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। নারীদের যৌন ও প্রজননস্বাস্থ্য সম্পর্কিত তথ্য ও সেবা প্রদানে এবং কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে ইউএনএফপিএ বর্তমানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছে।
মেয়ে ও নারীদের প্রতি সহিংসতা বাংলাদেশে একটি বড় উদ্বেগের বিষয় এবং তা সমাজের সব ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করছে। ২০১৫ সালের নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ থেকে দেখা যায় যে বিবাহিত নারীদের ৭৩ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে তাদের স্বামীদের দ্বারা শারীরিক, যৌন ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে যে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো জনসমাগমের স্থানে মেয়েরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। একাধিকবার এই সম্পর্কিত প্রতিবেদন দেশের সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় স্থান পেয়েছে।
নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডও)-এর নভেম্বর ২০১৬ প্রতিবেদনে কয়েকটি বিষয় বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন,বয়স-নির্বিশেষে বৈবাহিক ধর্ষণ, পারিবারিক নির্যাতন এবং সব ধরনের যৌন নিপীড়নসহ মেয়ে ও নারীদের প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে আইন করতে হবে। ভিকটিমের বয়স-নির্বিশেষে বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করাসহ পারিবারিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতনসহ সব ধরনের নারী নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অনতিবিলম্ব আইন প্রণয়ন করতে হবে। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করতে হবে, যাতে অপরাধী বিচারের আওতায় আসে ও উপযুক্ত সাজা পায় এবং নির্যাতনের শিকার মেয়ে ও নারীরা তাৎক্ষণিক নিরাপত্তা, সুরক্ষা, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণসহ উপযুক্ত বিচার পায়।
বিশ্বকে আরও বেশি জেন্ডার সংবেদনশীল এবং নারীদের আরও ক্ষমতায়নের জন্য প্রত্যেককে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। নারীদের অবস্থান সম্পর্কিত কমিশন (সিএসডব্লিউ) এবং সিডও বিশ্বব্যাপী নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এবং জাতীয় উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য এই ক্ষেত্রগুলোতে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি, সে সম্পর্কে সিএসডব্লিউ ও সিডও বাংলাদেশ সরকারকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত