পদক জয়ের শুরু
২৯তম আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে ১৫ জুলাই আমরা যখন রওনা হলাম, জামাকাপড়, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াও আমাদের ব্যাগের ভেতর ছিল বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা। গত দুই বছরও বাংলাদেশ এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে। কিন্তু কোনো পদক পাওয়া হয়নি। আমাদের ছোট দলটাকে নিয়ে বিমান যখন আকাশে উড়ল, ভাবছিলাম, এবার একটা পদক নিয়ে ফিরতে পারব তো?
ইন্টারন্যাশনাল টার্কিশ হোপ স্কুলের মো. বায়েজিদ মিয়া, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রকৃতি প্রযুক্তি, খুলনার সরকারি এম এম সিটি কলেজের মো. তামজিদ হোসেন আর আমি—এই চারজন মিলে বাংলাদেশ দল। দেশে ১৭০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জাতীয় অলিম্পিয়াডের মাধ্যমে আমাদের নির্বাচন করা হয়। দলনেতা হিসেবে সঙ্গে ছিলেন অধ্যাপক রাখহরি সরকার ও উপদলনেতা ছিলেন অধ্যাপক গাজী মো. জাকির হোসেন। ঢাকার এসএফএক্স গ্রিন হেরাল্ড স্কুল থেকে আমি ও লেভেল পরীক্ষা শেষ করেছি। বয়সের দিক থেকে আমিই ছিলাম সবার ছোট। তাই সবাই আমার সঙ্গে খুব আন্তরিক ছিল।
ইরানে পা রাখার পর আমরা সরাসরি চলে যাই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে ৭১টি দেশের শিক্ষার্থীদের সামনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতা কোনোভাবেই লিখে প্রকাশ করা যাবে না। নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করা দারুণ আবেগ ও গর্বের ব্যাপার। উদ্বোধনের দিন ছিল ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল। ফ্রান্স এবার জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়নি, কিন্তু ক্রোয়েশিয়ার শিক্ষার্থীরা ছিল আমাদের সঙ্গে। পরীক্ষার কথা ভুলে আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে ফাইনাল খেলা দেখলাম। ক্রোয়েশিয়ার বন্ধুরা সঙ্গে ছিল বলেই হয়তো আমরা ওদের সমর্থন করছিলাম। যদিও আমাদের মন খারাপ করে দিয়ে শেষে চ্যাম্পিয়ন হলো ফ্রান্স।
জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াড ছিল নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার এক দারুণ সুযোগ। আমার সঙ্গে পরিচয় হয় বেলজিয়ামের জেলডা ও স্লোভেনিয়ার ক্লেমেনের। ভূগোল ক্লাসের বাইরে ওরা বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছু শোনেনি। ওরা ভাবত, ঝড়-বৃষ্টি-প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত একটা দেশের নাম বাংলাদেশ। আমি ওদের আমাদের সমুদ্রসৈকতের কথা বলেছি, গ্রামবাংলার মানুষের কথা বলেছি। নতুন করে নিজের দেশকে চেনানোর কাজটা খুব কঠিন মনে হয়েছে।
আন্তর্জাতিক জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের পরীক্ষা রীতিমতো দুই দিনের টেস্ট ম্যাচ! দুই দিনে ৬ ঘণ্টা করে মোট ১২ ঘণ্টার পরীক্ষা। প্রথম দিন ছিল ব্যবহারিক পরীক্ষা। ইরানের শহীদ বেহেশতি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল ল্যাবরেটরিতে হাজির হলাম আমরা। সে এক দেখার মতো দৃশ্য। কেউ ব্যাঙ কাটছে, কেউ গান বা ডিএনএ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। দ্বিতীয় দিন ছিল তাত্ত্বিক পরীক্ষা। পুরো অলিম্পিয়াডের প্রশ্নই খুব কঠিন ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বা মেডিকেল কলেজে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, রীতিমতো সেসব ছিল আমাদের প্রশ্নের বিষয়।
দুই দিন টানা পরীক্ষা শেষে আমরা একটু ঘোরাঘুরির সুযোগ পেলাম। আমার কাছে মনে হয়েছে, ইরান অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। তবে আমাদের চেয়ে অনেক গোছানো ও পরিষ্কার। আমরা ইরানের বিভিন্ন বাজার ঘুরে ইরানি জাফরান, মিষ্টি, বাদামসহ অনেক কিছু কিনেছি। যতই পুরস্কার প্রদানের সময় ঘনিয়ে আসছিল, ততই আমরা দুশ্চিন্তা করছিলাম। অনুষ্ঠানে হাজির হলাম। অনেকটা সময় গেল, কিন্তু মঞ্চ থেকে আমাদের কাউকেই ডাকা হচ্ছিল না। হঠাৎ ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ শুনে চমকে গেলাম। মাথা তুলে দেখি, মঞ্চে আমাকে ডাকা হচ্ছে!
বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা নিয়ে মঞ্চের দিকে দিলাম ছুট। মেডেলটা আমার গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো। ইরানের শিক্ষামন্ত্রী ড. সাইয়্যেদ মোহাম্মদ বাত্তাহির হাত থেকে পদক নেওয়ার পরও বিশ্বাস হচ্ছিল না আমরা এবার একটা পদক পেয়েছি!
২০১২ সাল থেকে যাত্রা শুরু হলেও আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের কার্যক্রম স্বীকৃতি পায় ২০১৫-তে এসে। স্বীকৃতির তিন বছরের মধ্যে আমরা পদক পেয়েছি, যা আমাদের সবার জন্য দারুণ এক অনুপ্রেরণা। আমি বিশ্বাস করি, এটা কেবল শুরু। সামনের দিনগুলোতে নিশ্চয়ই আরও অনেক পদক বাংলাদেশের নামের পাশে যোগ হবে।