নারীর শ্রম ও মেধার মূল্যায়ন জরুরি
বাংলাদেশের রাজনীতির শীর্ষ পর্যায়ে আছেন নারীরা। জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারি দল এবং বর্তমান ও সাবেক বিরোধীদলীয় নেতাও নারী। আর এতেই কেউ কেউ তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন। কিন্তু এই নারীরা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অধিষ্ঠিত থাকার পরও নারী নির্যাতন কিন্তু কিছু কম হচ্ছে না। পরিবার থেকে কর্মক্ষেত্রে, পাহাড় থেকে সমতলে—সর্বত্রই নারীরা পুরুষের আগ্রাসী আচরণের শিকার।
রাষ্ট্রক্ষমতার গুরুত্বপূর্ণ স্তরে নারীদের উপস্থিতিই নারীর ক্ষমতায়নকে নিশ্চিত করে না; বরং সমগ্র রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি এবং সর্বোপরি সামাজিকভাবে নারীকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃতির ইতিবাচক পরিবর্তনই নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে নারীর শ্রম ও মেধার মূল্যায়নটাই সর্বাগ্রে জরুরি।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায় ১৯৭৪ সালে। কিন্তু এর পটভূমি তৈরি হয় দেড় শতাধিক বছর আগে, ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ, যখন নিউইয়র্ক শহরে সুই তৈরির কারখানার নারী শ্রমিকেরা বিপজ্জনক ও অমানবিক কর্মপরিবেশ, স্বল্পমজুরি ও দৈনিক ১২ ঘণ্টা শ্রমের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। ১৮৫৭ সালের ৮ মার্চের নিউইয়র্ক শহরের নারী শ্রমিকদের এই প্রতিবাদ প্রতিধ্বনিত হয়ে আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। আর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পর নারী দিবস উদ্যাপিত হচ্ছে সারা বিশ্বে। কিন্তু নারী দিবসের সঙ্গে শ্রমজীবী নারীদের ঐতিহাসিক যোগসূত্রটি অনেকটা বিস্মৃত হওয়ার পথে। অথচ নারীর ক্ষমতায়নের পথে শ্রমজীবী নারীদের অধিকারের প্রশ্নই সবার আগে সামনে আসা উচিত।
১৮৫৭ সালের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৮৬০ সালে সুই তৈরি কারখানার নারী শ্রমিকেরা ইউনিয়ন গঠনের আইনগত অধিকার আদায় করে নিতে সক্ষম হন। ন্যায্য মজুরি আর আট ঘণ্টা শ্রমের দাবি পূরণে ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ আবারও নিউইয়র্ক শহরের রাজপথে সমবেত হন পোশাক ও বস্ত্রশিল্পের হাজার হাজার নারী শ্রমিক। ঠিক পরের বছরই (১৯০৯) প্রায় একই দাবিতে আমেরিকার ৩০ হাজার নারী শ্রমিক ১৩ সপ্তাহ ধরে ধর্মঘট পালন করেন। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে সমাজতান্ত্রিক নারীদের প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনের দ্বিতীয় সভায় জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির নারীনেত্রী ক্লারা জেৎকিন শ্রমজীবী নারীদের বছরে একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্র হওয়ার একটা খসড়া প্রস্তাব করেন, যাতে ওই নির্দিষ্ট দিনে শ্রমিক নারীরা একত্র হয়ে মতবিনিময় করতে পারেন। ক্লারা জেৎকিনের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৮ মার্চকে নারীদের সম্মিলিত হওয়ার দিবস হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
আমাদের দেশে আজ সর্বত্রই নারীদের সরব উপস্থিতি। তবে নারীদের সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য বিজ্ঞাপনে! তা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনই হোক কিংবা শেভিং ক্রিমের। তবে বিজ্ঞাপনের পণ্যটির চেয়েও নারী মডেলটি বেশি আকর্ষণীয় হওয়া চাই! এভাবে পণ্যের বিজ্ঞাপনের নারীকেও আদতে পণ্য হিসেবেই উপস্থাপন করা হচ্ছে। নারী দিবসকে ঘিরে আজ অনেক কোম্পানি যখন নারীদের ব্যবহূত নানা পণ্যের বিজ্ঞাপন তৈরি করছে, সেখানেও নারীকে একইভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর পুঁজিবাদী দুনিয়ায় এটা মোটেও আজব কিছু নয়।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ দিক ব্যাপকতরভাবে নারীদের অংশগ্রহণ। এই আন্দোলনের বিশেষ অনুপ্রেরণা হিসেবে যাঁকে আমরা মনে করেছি, তিনি শহীদজননী জাহানারা ইমাম, যাঁর নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণ-আদালত গড়ে উঠেছিল। ৫ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে স্লোগান, গান কিংবা বক্তৃতায় আন্দোলনকে পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছেন নারীরা। শাহবাগ আন্দোলনকে ঘিরে কতিপয় কাগজ, ফেসবুকসহ সব সামাজিক মাধ্যম ও মুঠোফোনে সংগঠিতভাবে অপপ্রচারের মূল লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হন নারীরাই। শাহবাগের বিপরীতে গড়ে ওঠা হেফাজতের ১৩ দফা যেন নারীদের কয়েক শ বছর পিছিয়ে নেওয়ার এক অপচেষ্টা। তাদের দেখা যায় পোশাক কারখানার নারী শ্রমিকদের উদ্দেশ করে অবমাননাকর বক্তব্য দিতে। নারীশিক্ষার বিরুদ্ধেও এই ধর্মব্যবসায়ীদের ব্যাপক আক্রোশ। নারীনীতি বাতিলের দাবিতেও তাঁরা সোচ্চার ছিলেন।
গণজাগরণ মঞ্চের সব নারীযোদ্ধা এবং বাংলাদেশের সব নারী শ্রমিক এবং নারীমুক্তি আন্দোলনের সব সাহসী যোদ্ধাকে জানাই নারী দিবসের সংগ্রামী শুভেচ্ছা।