নজরকাড়া নাগরা
>সাধারণ মানুষের পা ঢাকার নাগরা একসময় বাদশাহ–নবাবদের নজরে আসে। মণি–মুক্তায় সজ্জিত হতে থাকে নাগরা। তারপর ফ্যাশনে নানাভাবে আসতে থাকে এই পাদুকা। এখন আধুনিকতার ছোঁয়া নাগরায়। ডিজাইনাররা বলছেন, আসছে গরমকালে নাগরার জনপ্রিয়তা থাকবে তুঙ্গে।
কোনো কোনো দেশে বলে মাজোরি, কেউ বলে খুসসা। কোথাও আবার একে বলা হয় জুত্তি বা মুজরা। তবে আমাদের দেশে ফ্যাশনসচেতনদের কাছে এটি নাগরা নামেই পরিচিত। নাগরার উদ্ভাবন ও বিবর্তনের ইতিহাসটাও বেশ মজার। এখন কেমন নাগরার চল, তা শোনার আগে এর পেছনের গল্পটা ছোট্ট করে একটু জেনে নেওয়া যাক।
মোগলরা এ দেশে আসার আগে ভারতীয় উপমহাদেশের কিছু জায়গায় ছিল চীনাদের প্রভাব। পায়ের জুতাজোড়াও চৈনিক ব্যবসায়ীদের হাত ধরে আসত তখন। তবে কাঠের তৈরি সেসব পাদুকা এই অঞ্চলের গরম আবহাওয়ার জন্য ছিল কষ্টকর। তাই চীনের ওপর ভরসা না করে এ দেশের চর্মকারেরা নিজেরাই চামড়া দিয়ে একরকম পাদুকা বানিয়ে ফেললেন। যার মুখের দিকটা ছিল ত্রিকোণাকৃতির। কৃষিনির্ভর অঞ্চলের মাঠে–ময়দানে এ ধরনের জুতা ছিল কৃষকদের জন্য খুবই উপযোগী ও আরামদায়ক। এর নামই মূলত মাজোরি বা খুসসা, যা পরবর্তী সময়ে নাগরা নাম পায়।
ধারণা করা হয়, সিন্ধু নদের অববাহিকায় প্রথম নাগরার প্রচলন হয়। ধীরে ধীরে এর আকার–আকৃতিতে আসে অনেক পরিবর্তন। শুধু কি তা–ই? নাগরার ইতিহাসে আছে আরও অনেক মোড়। জনসাধারণের পা ঢাকার এই পাদুকা একসময় ঢুকে পড়ে মোগলদের আঙিনায়।
জি, নাগরার প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং সম্রাট জাহাঙ্গীর। তিনিই সাধারণ নাগরার রাজকীয় রূপকার। তাঁর শাসনামলে মোগল দরবারে সবার পায়ে-পায়ে রত্নখচিত সব নাগরা শোভা পেতে শুরু করে। নাগরার ওপর সোনা-রুপার সুতা দিয়ে নকশা তুলে এতে মণিমুক্তা বসিয়ে একেবারে এলাহি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন বলে নাগরাকে সেলিম শাহি জুত্তিও বলা হতো সে সময়। এরপর সেই নাগরা আবারও ফেরত আসে সাধারণ মানুষের পায়ে। ভিন্ন রূপে ও নকশায়। নাগরা সম্পর্কে উপমহাদেশীয় লাইফস্টাইল ব্লগার হাজরা সাঈদের লেখা থেকে এমনই সব চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া যায়।
নাগরার বিশেষত্ব এর পুরোটাই হাতে তৈরি। চামড়া কাটা থেকে শুরু করে ওপরের নকশা, সেলাই—সবই কারিগরের হাতের জাদু। চলতি সময়ে এসে নাগরাকে নতুন রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশি ডিজাইনাররাও। জারদৌসি, জরি, চুমকি আর রাজস্থানি কারুকাজ তো নাগরায় বহু দেখেছেন। ইদানীং বাংলাদেশি নকশিকাঁথার দেখা মিলছে নাগরায়। লা মোডের স্বত্বাধিকারী ফাহমিদা ইসলাম রঙিন নাগরায় ফুটিয়ে তুলেছেন জামালপুরের ঐতিহ্যবাহী সুতার কাজ। তিনি ও আরেক উদ্যোক্তা দিলরুবা মোহনা মিলে লোকজ এই কারুশিল্প হাল ফ্যাশনের নাগরায় নিয়ে এসেছেন। ফাহমিদার মতে, এই নাগরাগুলো কেবল একজোড়া জুতা নয়, বরং দেশের ঐতিহ্যের একটি প্রতীক। দেশীয় কারুকাজ এর আগে এভাবে নাগরায় দেখা যায়নি।
প্রশ্ন করতে পারেন, নাগরার সঙ্গে পোশাকটা কেমন চাই। কোরাল ক্লজেটের ডিজাইনার রুপো শামস তা বাতলে দিলেন। ঢাকা প্যান্ট, ইজার প্যান্ট, কিউলেটস, চুড়িদার ও গারারার সঙ্গে নাগরা খুব সুন্দর মানিয়ে যায়। সালোয়ারের সঙ্গেও মন্দ নয়। এখন তো টপ আর জেগিংসের সঙ্গেও তরুণীরা নাগরা পরছেন হরদম।
নাগরা আছে অনেক রকম। কোনোটার সামনের দিক চোখা, কোনোটা একটু ভোঁতা। তবে এখন সামনের দিক ভোঁতা বা ডিমাকৃতির নাগরাগুলোই পছন্দ করছে সবাই। কিছু নাগরায় থাকছে পমপম। এমনটাই জানা গেল ওয়ারাহর ডিজাইনার রুমানা চৌধুরীর কাছে। তিনি বলছেন, ঐতিহ্যবাহী ও সমসাময়িক দুই ধরনের নাগরাই চলছে এখন। কী ধরনের পোশাকের সঙ্গে পরা হবে তার ওপর নির্ভর করেই নাগরা বেছে নিতে হবে। তাঁরা এবার মোটিফভিত্তিক নাগরা এনেছেন। সুই–সুতার ফোঁড়ে নাগরায় তুলেছেন ফুল ও পাখির মোটিফ।
অন্যদিকে চামড়ার সাদাসিধা নাগরাও ফ্যাশনে দখল করে নিয়েছে নিজ স্থান। বাজারে ব্রাইডাল নাগরায় পাবেন পুঁতি, চুমকি, জরির কাজ। আছে নকল কুন্দন ও ডলারের ব্যবহার। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সম্পূর্ণ দেশীয় সুই–সুতার কাজ। ফ্যাশনপ্রেমীদের অনেকে আবার প্রিন্টের নাগরাও পরছেন আজকাল।
সমান সোল, তাই নাগরায় চলেফিরে আরাম। নিয়মিত ব্যবহার ও নিমন্ত্রণ দুই জায়গাতেই নাগরা এখন পছন্দের তালিকায় ‘এক নম্বর’। ফাহমিদা ইসলামের ভাষায়, ‘নাগরা ভীষণ ভার্সেটাইল।’ এই ধারা তুঙ্গে থাকবে বেশ কিছুদিন। ধারণা করা হচ্ছে, এবারের গরমকালে এর জনপ্রিয়তা বাড়বে কয়েক গুণ।