যৌনকর্মীদের জন্য একটা কিছু করতে চেয়েছিলেন নিয়ালানা নওশীন। মানুষের কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন এই নারীদের দুঃখগাথা। সে লক্ষ্যেই তৈরি করেছেন একটি তথ্যচিত্র। তখনো ভাবতে পারেননি, এই তথ্যচিত্র তাঁকে একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দেবে। নওশীন বলেন, ‘২০১৭ সালে আমি দিশা ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করি। তখন থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য তাঁদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি নিয়ে কাজ করছি। সেসব কাজের অংশ হিসেবে ছোট্ট একটি ভিডিও প্রতিবেদন বানিয়েছিলাম। পুরস্কার, পদক—এসব কখনোই লক্ষ্য ছিল না।’
লক্ষ্য না থাকলেও নিয়ালানা নওশীনের সেই ভিডিও প্রতিবেদন পেয়েছে জাতিসংঘের ‘প্লুরাল প্লাস’ পুরস্কার। গত ২১ নভেম্বর, নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দপ্তরের পালে মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত এক জমকালো অনুষ্ঠানে নওশীনের হাতে পদক ও সনদ তুলে দেওয়া হয়েছে। নওশীন বলেন, ‘এটি ছিল একটি বৈশ্বিক চলচ্চিত্র উৎসব। ইউনাইটেড নেশনস অ্যালায়েন্স অব সিভিলাইজেশন (ইউএনএওসি) ও ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইএমও) যৌথভাবে এর আয়োজন করে থাকে। সারা পৃথিবীর তরুণেরা এ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলেন। আমি “রিয়েল গার্ল” ক্যাটাগরিতে পুরস্কারটা পেয়েছি।’
তবে এই পুরস্কারই প্রথম নয়। এর আগেও পুরস্কার পেয়েছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের শিক্ষার্থী নিয়ালানা নওশীন। কিশোরী ধর্ষণের ওপর তৈরি করা তাঁর একটি ভিডিও প্রতিবেদন হার্ভার্ড কলেজ সোশ্যাল ইনোভেশন কোলাবোরেটিভের আয়োজনে ‘কানেক্ট হার: গার্লস ইমপ্যাক্ট দ্য ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ প্রতিযোগিতায় সেরা নির্বাচিত হয়েছে। পুরস্কার হিসেবে পেয়েছেন আড়াই হাজার মার্কিন ডলার (প্রায় ২ লাখ ১১ হাজার টাকা)। অষ্টম ইউএনএওসি তরুণ সম্মেলনেও অংশ নিয়েছেন তিনি।
এসব পুরস্কার, অর্জন তাঁকে অনুপ্রাণিত করে বটে। তবে একজন নারী যৌনকর্মীর মুখে হাসি ফোটানোর যে আনন্দ, সেই আনন্দের কাছে অন্য সবই ম্লান হয়ে যায়। নওশীন জানালেন, এখন পর্যন্ত তিনি চার শতাধিক নারী যৌনকর্মীকে নানাভাবে সহায়তা করেছেন। তাঁদেরকে এইডস ও স্যানিটেশন সম্পর্কে সচেতন করতে অনেকগুলো কর্মশালা পরিচালনা করেছেন। ৪৭ জন যৌনকর্মীর সন্তানকে স্কুলে পড়তে সাহায্য করেছেন। ১২ জন কিশোরী ধর্ষিতাকে শেল্টার হোমে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। তাদের পড়ালেখারও ব্যবস্থা করেছেন নিয়ালানা নওশীন।
আর আপনার পড়ালেখা? হেসে বললেন, ‘আমি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে রাজনীতি, দর্শন ও অর্থনীতি বিষয়ে স্নাতক শেষ সেমিস্টারে পড়ছি।’
পড়ালেখা তো শেষ পর্যায়ে। ক্যারিয়ার পরিকল্পনা কী? জানতে চাই আমরা। নওশীন বলেন, ‘দেশের বাইরে স্নাতকোত্তর করার ইচ্ছা। বিশেষ করে সিঙ্গাপুরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষাবৃত্তির চেষ্টা করছি। স্নাতকোত্তর শেষ হলে দেশে ফিরে সমাজসেবাই করতে চাই। বলতে পারেন, এটাই আমার ক্যারিয়ার।’
কথায় কথায় জানা গেল, ছোটবেলা থেকে বাবাই তাঁর মনে সমাজসেবার স্বপ্ন বুনে দিয়েছেন। নওশীনের বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘মানুষ হয়ে জন্মেছ, মানুষের জন্য কিছু করো। সমাজের জন্য কিছু করো।’ বাবার সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের সমাজসেবামূলক কাজ করতে শুরু করেন আগা খান স্কুল থেকে ‘ও’ লেভেল এবং ‘এ’ লেভেল পেরোনো এই তরুণী। তিনি বলেন, ‘উত্তরায় অটিস্টিক শিশুদের একটি স্কুল আছে। সেখানে বাচ্চাদের ছবি আঁকা শেখাতাম আমি।’
এভাবেই নিজের ভিতটা গড়েছেন। তাঁর এসব সমাজসেবামূলক কাজে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা করেন বাবা, মা, ভাই, বন্ধুবান্ধব, গৃহকর্মী ও গাড়ির চালক। ‘অসহায় শিশুদের শীতবস্ত্র দেব। এখন বাসার সবাই মিলে কাপড়গুলো প্যাকেটবন্দী করছি।’ বলছিলেন তিনি। ভবিষ্যতে দিশা ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে শিশু, নারী যৌনকর্মী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ ও স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা করতে চান এই উদ্যমী তরুণী।