ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার আমরা
ধর্ষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন নারীরা, তাঁদের কথায়–লেখায় এ তো জানা কথাই। কিন্তু এবার নারীমঞ্চে যাঁরা লিখেছেন তাঁরা দেশের জনপ্রিয় তারকা এবং তাঁরা পুরুষ। খেলা, অভিনয়, সংগীতজগতের তিনজন জনপ্রিয় তারকা তাঁদের লেখার মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন ধর্ষকের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। চেয়েছেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। যাঁদের খেলা, অভিনয়, গান হাজার ভক্তের হৃদয় নাড়া দেয়, তাঁদের কথার শক্তি নিশ্চয় আলাদা।
আজ চুপ থাকলে কাল বিপদ আপনার
মুশফিকুর রহিম
ক্রিকেটার, বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল
মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি আসলেই মানুষ! নাকি অন্য কিছু? হায়েনা বা তার চাইতেও হিংস্র কোনো প্রাণী? মানুষ তো মানুষের মতো আচরণ করবে। সৃষ্টির সেরা জীব সে। কিন্তু আমরা আসলেই কি সে রকম আচরণ করছি? আমার কাছে তো মানুষের মনুষ্যত্বই আজ প্রশ্নবিদ্ধ!
সংবাদপত্র খুললেই চোখে পড়ে ধর্ষণের খবর। মানুষরূপী হায়েনারা শিশু-বয়স্ক কিছুই মানছে না। তারা যেন ভুলেই গেছে তাদের ঘরেও মা আছে, বোন আছে, মেয়ে আছে। বিকৃত এই মানুষদের জন্য ধর্ষণ আজ আমাদের দেশে সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমাদের বোনেরা, মায়েরা, কন্যারা কোথাও নিরাপদ নন। রাস্তার ভিখারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী—সবাই অনিরাপদ। গৃহবধূরা নিজের ঘরে পর্যন্ত নিরাপদ নন। স্বামী পারছে না স্ত্রীর সম্ভ্রম বাঁচাতে। বাবা পারছেন না মেয়েকে রক্ষা করতে। আমরা কেউই পারছি না আমাদের মা-বোনদের নিরাপত্তা দিতে। এ ব্যর্থতা আমাদের সবার। এ ব্যর্থতা সমাজের।
ধর্ষণ ও ধর্ষণকারীদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে দেশে জোরালো প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। আমি এই প্রতিবাদের সঙ্গে আগেই একাত্মতা প্রকাশ করেছি। আমার কথা, আমরা সবাই মিলে একতাবদ্ধ হয়ে এই অমানুষদের সামাজিকভাবে প্রতিহত করতে পারি। তাদের মুখোশ খুলে দিতে পারি। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ পরিবারের নারী সদস্যদের কথা ভাবা। দেশটাকে, সমাজটাকে তাদের জন্য নিরাপদ করে তোলা। আজ হয়তো অন্য কারও সন্তানের, বোনের সম্ভ্রম গেছে। সেটি দেখে যদি আমি-আপনি চুপ করে থাকি, তাহলে কাল আমাদের পরিবারের কেউও অমন নির্যাতনের শিকার হতে পারে। কাজেই ধর্ষক যে–ই হোক, তাকে ঘৃণা করতে হবে। তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা অনেক প্রতিশ্রুতি শুনেছি, অনেক কথা শুনেছি; তবু আমাদের মা-বোনেরা আজও একই রকম অনিরাপদ রয়ে গেছেন। ১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধে এ দেশের অসংখ্য নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা আর তা চাই না।
ধর্ষণ একজন নারীকে মরার আগেই মেরে ফেলে। বাকি জীবন তাঁকে ভয়ংকর একটা দুঃস্বপ্ন বয়ে বেড়াতে হয়। অনেকে তো আত্মহত্যার পথও বেছে নেন। ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবারও সামাজিক ও মানসিকভাবে আর কখনো সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। যার বা যাদের কারণে একজন মানুষ, একটি পরিবার এভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, আমি তার সর্বোচ্চ সাজা চাই। এবং আমার ব্যক্তিগত মত, মানুষরূপী প্রত্যেক ধর্ষককে এই সর্বোচ্চ সাজাতেই দণ্ডিত করা উচিত। যত দিন না এ রকম কঠোর শাস্তির বিধান হবে, তত দিনই হয়তো বাংলার মাটিতে ধর্ষকদের আস্ফালন আমাদের দেখে যেতে হবে। সৃষ্টি হবে নতুন নতুন ধর্ষক।
আমাদের সমাজের অনেক জায়গায় এখনো সেই ধর্ষণের শিকার নারীকেই বাঁকা চোখে দেখা হয়। সেই পরিবারকেই বিড়ম্বনার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অথচ হওয়া উচিত উল্টোটা। ধর্ষকের শাস্তি তো নিশ্চিত করতেই হবে, যদি তার পরিবার তার পক্ষে থাকে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধেও সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
আর একটা কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে নারীদের প্রতি শ্রদ্ধার মনোভাব তৈরি করতে হবে। তারা যেন নারীদের সম্মান করতে শেখে। নারীকে কখনো অসহায়, অবলা না ভাবে। পণ্য না ভাবে। স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায় নৈতিক শিক্ষার ওপর জোর দিতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা যে একটা ঘৃণ্য কাজ, শিশু-কিশোরদের মানসিকতায় সেটি ঢুকিয়ে দিতে হবে। আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তারা যেন নারীদের রক্ষা করতে শেখে।
আমাদের পুরুষশাসিত সমাজে নারীরা এমনিতেই অবহেলিত, নিগৃহীত। আমরা কোথায় তাদের সেই জায়গা থেকে এনে সম্মানের আসন দেব তা নয়, আমাদের কাছে নারীরা যেন দিনে দিনে আরও অনিরাপদ হয়ে উঠছে! কিন্তু আর নয়। আসুন, ধর্ষকদের বিরুদ্ধে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। নারীদের সম্মান করি। সত্যিকারের মানুষ হই।
অনুলিখন: তারেক মাহমুদ
কন্যাসন্তানের বাবা হিসেবে আমি ভীত
ফেরদৌস, চলচ্চিত্র অভিনেতা
জেগে উঠুন পুরুষেরা; জাগ্রত করুন আপনার বিবেক, বুদ্ধি আর মূল্যবোধ। একমাত্র একজন পুরুষই পারে নিজের সুশিক্ষা, সদিচ্ছা, সততা আর ভালো–মন্দের ভেদাভেদ দিয়ে ধর্ষণের মতো এমন জঘন্য পাশবিক, অমানবিক আচরণকে রোধ করতে। কারণ, একজন ধর্ষক বাস করে আমার–আপনার–আমাদেরই মধ্যে। কী করে একজন পুরুষ নিজের পাশবিক প্রবৃত্তিকে নিবৃত্ত করতে স্থান–কাল–পাত্র ভুলে একজন নারীকে ধর্ষণ করতে পারে? নিমেষে হিতাহিত জ্ঞানটুকু হারিয়ে ফেলে নারীর সম্ভ্রমটুকু নষ্ট করে দেয়। নারীকে শারীরিকভাবে, মানসিকভাবে নির্যাতন করে (একা বা দলগতভাবে)। যিনি হয়তো কারও মা, বোন কিংবা সন্তান। সেই নারীরই হঠাৎ সমাজের কাছে পরিচয় হয় তিনি ধর্ষণের শিকার একজন নারী।
ছি, এ লজ্জা ধর্ষণের শিকার একজন নারীর না। এ লজ্জা আমার, এই কলঙ্ক আমাদের সবার—তথাকথিত পুরুষদের (সমাজের)।
ধন্যবাদ আইন মন্ত্রণালয়কে, সময়োপযোগী আইন সংশোধন এবং প্রণয়নের অঙ্গীকার করার জন্য। এখন প্রয়োজন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োগ করা। একজন ধর্ষকের শাস্তি এমন ভয়ংকর হওয়া উচিত, যা দেখে আর কেউ কখনো দুঃস্বপ্নেও এমন অপকর্মের কথা না ভাবে। আমি জ্ঞানত কখনো কারও মৃত্যু কামনা করি না। কিন্তু ধর্ষকের মতো নরপিশাচ, যার ব্যাভিচারে যেকোনো আবালবৃদ্ধবনিতার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, যার অত্যাচারে একজন নারী জীবন্মৃত হয়ে থাকেন, তার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডও অনেক কম।
দুই কন্যাসন্তানের বাবা হিসেবে আজ আমি ভীত–সন্ত্রস্ত। একদিকে করোনার মতো মরণব্যাধির ভয়াবহতা, তার ওপর এই নরদানবদের ভয়াল গ্রাস। মাঠঘাটে, স্কুল–কলেজে—এমনকি চলন্ত বাস–ট্রেনে অহরহ এমন ধর্ষণের ঘটনা আমাদের দিন দিন আরও বেশি আতঙ্কিত করে তুলছে। আকাশ–বাতাস প্রকম্পিত করা একজন ধর্ষণের শিকার নারীর চিৎকারে প্রত্যেক সচেতন মানুষ আজ তাঁদের পক্ষে বিচার চাইতে, এই ঘৃণ্য অপরাধকে প্রতিহত করতে রাজপথে নেমেছে। মিছিল, আন্দোলন করছে।
মানবিক মূল্যবোধ ধসে যাওয়ার আগেই আমি প্রত্যেক সচেতন মানুষকে, বিশেষ করে পুরুষদের বলব, নারীর সঙ্গে এমন জঘন্যতম ঘৃণ্য আচরণ বন্ধ করুন। আজ বন্ধ না করলে কাল হয়তো আপনার ঘরের মা–বোন–সন্তান অন্য কোনো মানসিক বিকারগ্রস্ত পুরুষ দ্বারা হবেন লাঞ্ছিত, অপমানিত কিংবা ধর্ষিত।
বাবা–মায়েদের বলব, দয়া করে দেখুন আপনার বাড়ন্ত সন্তানটি কার সঙ্গে মেলামেশা করে, কারা তার বন্ধু। প্রয়োজনে সন্তানের সঙ্গে নিজেরাই গভীর বন্ধুত্ব তৈরি করুন। তাকে সংস্কৃতিচর্চায়, ধর্মে–কর্মে–শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে তুলুন। আকাশ সংস্কৃতির এই সময়ে নজরদারি করুন সে তার মুঠোফোনে কী দেখছে, কার সঙ্গে যোগাযোগ করছে, পারিবারিকভাবেই আমাদের চেষ্টা করা উচিত জন্মের পরপরই একটি শিশুকে ভালোর পথে আলোর পথে নিয়ে আসার।
সুশিক্ষায় শিক্ষিত সমাজসচেতন একজন সংস্কৃতিমান ও বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ, যার রয়েছে পারিবারিক অটুট বন্ধন, সে কখনো কোনো অন্যায় বা অনৈতিক কাজ করতে পারে না। ধর্ষণ তো নয়ই—এটাই আমার বিশ্বাস।
হোক কলরব
অর্ণব, সংগীতশিল্পী
মানুষের মধ্যে যখন মনুষ্যত্ব থাকে না, তখন সে হয়ে ওঠে বর্বর। আর তার আচরণেই ফুটে ওঠে সেই বর্বরতা। এ ধরনের মানুষের সংখ্যা দিন দিন যেন বাড়ছেই। এই অমানুষদের কারণেই আমাদের দেশ, সমাজ, চারপাশে হচ্ছে নৈতিক অবক্ষয়।
একজন নারী কখনো আমার মা, কখনো আমার বোন, কখনো আমার বউ, কখনোবা আমার সন্তান। কিন্তু প্রায় প্রতিদিনই একদল বর্বর মানুষের ঘৃণা, লোভ ও পৈশাচিক আচরণের শিকার হচ্ছেন আমাদের কোনো মা, কোনো বোন, কোনো সহধর্মিণী, কোনো শিশু। এই নৈতিক অবক্ষয় থেকে মুক্ত করতে আমাদের সবাইকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। নারী ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। সবাই যেন স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে, আর যেন না ঘটে এ ধরনের বর্বর ঘটনা। সেই নিশ্চয়তা আমাদেরই দিতে হবে। আমি আমার গানের মাধ্যমেই প্রতীকী প্রতিবাদ করছি—
হোক কলরব, ফুলগুলো সব
লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান
অসম্ভবে কখন কবে
মেঘের সাথে মিল হলো ক্যান
হোক অযথা এসব কথা
তাল না হয়ে তিল হলো ক্যান
কুয়োর তলে ভীষণ জলে
খাল না হয়ে ঝিল হলো ক্যান
ধুত্তরি ছাই মাছগুলো তাই
ফুল না হয়ে চিল হলো ক্যান
হোক কলরব, ফুলগুলো সব
লাল না হয়ে নীল হলো ক্যান।