২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

দেলোয়ারার ৫ হাজার টাকার পুঁজি এখন কোটি টাকা

জামালপুরে নিজের প্রতিষ্ঠানে দেলোয়ারা বেগম
ছবি: প্রথম আলো

ছোট থেকেই চঞ্চল ছিলেন দেলোয়ারা বেগম। প্রবল আগ্রহ ছিল তাঁর নিজের চেষ্টায় কিছু করার। সে চেষ্টায় কিছুটা বাধা পেলেন ১৮ বছর বয়সে। এ সময় তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। স্বামীর সংসারে সীমিত আয়ের ধাক্কা। উদ্যমী দেলোয়ারা কিছু করার চেষ্টা করলেন।

দেলোয়ারার সেই ‘কিছু’ করাটা ছিল সেলাই ও কাপড়ে নকশার কাজ। নিজে সেলাইয়ে হাতেখড়ি নিলেন। পাঁচ হাজার টাকা পুঁজি আর পুরোনো একটি সেলাই মেশিন নিয়ে যাত্রা শুরু সেলাই-ফোঁড়াইয়ের। জীবনের লক্ষ্য ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে তিনি এখন দাঁড় করিয়েছেন কোটি টাকার ব্যবসা। একই সঙ্গে বহু নারীকে সেলাই, পোশাক তৈরি, নকশা, রং করা, বাটিকসহ নানা কাজ শিখিয়ে পারদর্শী ও স্বাবলম্বী করে তুলেছেন।

দেলোয়ারা বেগম নিজের চেষ্টা আর পরিশ্রমে ২০ বছরে আজ জামালপুর জেলার বিখ্যাত নকশিকাঁথা ও অন্যান্য হস্তশিল্প তৈরির এক সফল দক্ষ উদ্যোক্তা। এখন তিনি ‘দীপ্ত কুটির’ নামের কোটি টাকার একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক। ১৪ সেপ্টেম্বর দুপুরে দীপ্ত কুটির দোকানে দীর্ঘ ব্যবসায়িক জীবনের সফলতার গল্প শোনালেন দেলোয়ারা বেগম। ৪৮ বছর হওয়ার পরও একজন তরুণীর মতোই ব্যবসা সামলাচ্ছেন।

ময়মনসিংহ শহরে বেড়ে ওঠা দেলোয়ারা বেগমের। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। তিনি বললেন, ‘১৯৯০ সালে বিয়ে হয়। স্বামী নিজাম উদ্দিন চাকরিজীবী। শ্বশুরবাড়ি জামালপুর সদর উপজেলার মেষ্টা ইউনিয়নের হাজিপুর এলাকায়। স্বামীর চাকরির সুবাদে বিয়ের সাত বছর পর ঢাকার বাসাবোতে থাকতে শুরু করি। সংসারে তখন দুই সন্তান। স্বামীর সীমিত আয়ে ভালো চলছিল না সংসার। তাঁকে সহযোগিতার জন্য ঢাকায় যুব উন্নয়নের সেলাই প্রশিক্ষণ, পোশাক তৈরি, ব্লক বাটিক ও হস্তশিল্পের বিভিন্ন পণ্যের প্রশিক্ষণ নিই।’

২০০০ সালে স্বামীর বদলি হলো, দেলোয়ারারা চলে এলেন জামালপুরের ঢাকাইয়া পট্টি এলাকায়। মাসখানেক পর পাঁচ হাজার টাকার পুঁজি ও একটি সেলাই মেশিন নিয়ে সেখানে গড়ে তোলেন দীপ্ত কুটির। এখন দীপ্ত কুটিরের পুঁজি গিয়ে দাঁড়িয়েছে কোটি টাকার বেশি। এ ছাড়া ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট ও মনিপুরে একটি শোরুম করেছেন দেলোয়ারা বেগম। জামালপুর শহরে ৩ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করছেন ছয়তলা ভবন। শিগগির নতুন ভবনে শুরু হবে দেলোয়ারার বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই ভবনে থাকবে নিজেদের থাকার ফ্ল্যাট, প্রশিক্ষণকেন্দ্র আর বিশাল শোরুম। দেলোয়ারার প্রতিষ্ঠানে এখন চাকরি করছেন ৪২ জন কর্মী। তাঁদের বেশির ভাগই নারী।

দেলোয়ারা এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ হাজার নারীকে সেলাই, পোশাক তৈরি, নকশা, রং করা, বাটিকসহ নানা কাজ শিখিয়ে পারদর্শী ও স্বাবলম্বী করে তুলেছেন। তাঁরাও উদ্যোক্তা হয়ে অর্থ উপার্জন করছেন। তাঁদের মধ্য থেকে অনেকেই সফল উদ্যোক্তাও হয়েছেন।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে দেলোয়ারা বেগম বেশ কিছু পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৮ সালে জাতীয় যুবমেলায় দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্টল, শ্রেষ্ঠ আত্মকর্মী নারী কোটায় ২০১২ সালে জাতীয় যুব পুরস্কার, জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তার বর্ষসেরা ক্ষুদ্র নারী উদ্যোক্তা এবং একই বছর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে শ্রেষ্ঠ নারী উদ্যোক্তা হিসেবে পেয়েছেন ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার ও পদক। ২০১৩ সালে সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে মানবাধিকার সম্মাননা পদক পেয়েছেন। জাতীয় এসএমই নারী উদ্যোক্তার বর্ষসেরা সম্মাননা ক্রেস্ট ও দুই লাখ টাকা পুরস্কার পেয়েছেন একই বছরে।

দেলোয়ারার প্রতিষ্ঠান নকশিকাঁথা, থ্রি-পিস, পাঞ্জাবি, ফতুয়া, টি-শার্ট, শাড়ি, লেডিস পাঞ্জাবি, ওজনা, বিছানার চাদর, শাল, চাদর, বালিশের কভার, নারীদের সাইড ব্যাগ, ওয়ালম্যাট, কুশন কভারে রংবেরঙের নকশার নানা পণ্য তৈরি করে। এসব হস্তশিল্প পণ্য জামালপুর, ঢাকাসহ সারা দেশে বিক্রি হয়। এ ছাড়া নেপাল, চীন, ভারতের দিল্লি, কলকাতা, শিলিগুড়িসহ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় পাইকারি বিক্রি হয়ে থাকে।

জামালপুরের নান্দিনা এলাকার আকলিমা আক্তার। তিনি নিজেও একজন উদ্যোক্তা। তিনি হস্তশিল্পের কাজ শিখেছেন দেলোয়ারা বেগমের কাছ থেকেই। তিনি বলেন, ‘আপার কাছ থেকেই কাজ নিয়ে গ্রামের নারীদের দিয়ে কাজ করাই। এতে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। গ্রামের অন্য নারীরাও আমার মতো মাসে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘরে বসেই আয় করছেন। এতে সবার সংসারে খরচ করতে পারেন এবং ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচ জোগান দেওয়া যায়। এসব সম্ভব হয়েছে আপার কারণেই। আমার মতো বহু নারী আজ স্বাবলম্বী হয়েছেন।’

জামালপুর শহরের পাথালিয়া এলাকার শিক্ষার্থী আলপনা খাতুন। লেখাপড়ার পাশাপাশি হস্তশিল্পের কাজ করেন। তিনিও দেলোয়ারা বেগমের কাছ থেকেই কাজ শিখেছেন। বর্তমানে তিনি দীপ্ত কুটিরেই চাকরি করেন। এতে তিনি একজন দক্ষ কর্মী হয়ে উঠেছেন। একইভাবে হাটচদ্রা এলাকার জুলেখা বেগম স্বামী মারা যাওয়ার পর আসেন দেলোয়ারা বেগমের কাছে। কাজ শিখে দীপ্ত কুটিরেই যোগ দিয়েছেন। বেতনের টাকায় তিনি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও সংসার চালান। জুলেখা বেগম বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর সাগরে ভাসছিলাম। আপার কাছে কাজ শিখেছি। পরে আপা তাঁর প্রতিষ্ঠানেই চাকরি দিয়েছেন।’

দেলোয়ারা বেগম বলেন,‘ছোট্টবেলা থেকেই কিছু করার খুব আগ্রহ ছিল। লেখাপড়াতেও ভালোই ছিলাম। তবে পরিবার খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। কিন্তু স্বামীর সংসারে টানাটানি লেগেই থাকত। স্বামীকে সহযোগিতা করতেই এই ব্যবসায় নামি। প্রথম দিকে নানা বাধা আসছে। সব বাধা ডিঙিয়ে সফলতা ধরা দিয়েছে। আমার বড় মূলধন ছিল সততা ও নিষ্ঠা, যা আমাকে অনেক দূর নিয়েছে।’