‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’
সড়কের মোড়ের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে, বাড়ির প্রাচীরে কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের গাছে কত রকম চটকদার বিজ্ঞাপনই না চোখে পড়ে। সেসবের ভিড়ে ‘শুধুমাত্র দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’ লেখা বিজ্ঞাপনটি ব্যতিক্রমই বটে। ব্যতিক্রম বলেই বিজ্ঞাপনটি সবার নজর কেড়েছে, ছড়িয়ে পড়েছে ফেসবুকে।
বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ এলাকায় জহুরুলনগরের একটা বাড়ির প্রাচীরে সাঁটানো বিজ্ঞাপনটি সপ্তাহখানেকের পুরোনো। বিজ্ঞাপনদাতা আলমগীর হোসাইন নিজের পরিচয়ে লিখেছেন ‘বেকার’। দুবেলা ভাতের বিনিময়ে প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পড়াতে চান তিনি।
বিজ্ঞাপনে দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে আলমগীর হোসাইনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। কুশলাদি বিনিময়ের পর জানান, তাঁর গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার মোহাম্মদপুর ইউনিয়নের বুড়ইল গ্রামে। শৈশব থেকে অভাবের সঙ্গে লড়াই সংগ্রাম করছেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বগুড়ায় এসে পড়াশোনা করেছেন। পাঁচ বছর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অর্জন করেন। মেধাতালিকায় দেশসেরা আলমগীর স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফলাফলেও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। পড়াশোনা শেষে হন্যে হয়ে একটা ভালো চাকরি খুঁজেছেন, কিন্তু পাননি। এখন অন্যের বাসায় জায়গির হিসেবে কোনোরকমে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধ্যায় একটি বাসায় ছাত্র পড়ানোর বিনিময়ে রাতের খাবার খান। খাবার খরচ জোগাতে না পারায় সাত মাস ধরে অন্য দুবেলা অনাহারে কাটাচ্ছেন।
আলমগীরের সঙ্গে আলাপের পর গত শুক্রবার সকালে গিয়েছিলাম জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় তাঁর গ্রামের বাড়িতে। বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল বসতভিটাজুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ। টিনের ছাপরা ও মাটির দুটি ঘরে থাকে তাঁর পরিবার। ঘরে কাঠের চৌকি ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। এক ঘরে থাকেন বৃদ্ধা মা-বাবা, অন্য ঘরে থাকেন অটিস্টিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বড় ভাই, বোন ও ভাগনে-ভাগনি। আলমগীর বাড়িতে গেলেও এই ঘরেই ঠাঁই হয়।
বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়েই কথা হয় আলমগীর হোসাইনের মা আম্বিয়া বেগমের সঙ্গে। তিনি জানান, তাঁর স্বামী কফিল উদ্দিনের বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই। পেশায় হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। একসময় গ্রামের পাশে বেড়াখাঁই বাজারে ছোট্ট একটা হোমিও দোকান ছিল। দিনে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা রোজগার হতো। তা দিয়ে সংসার চলত। ২০২০ সালে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতা দেখা দেয় তাঁর। চিকিৎসার খরচ জোগাতে দোকান ছাড়াও এক বিঘা আবাদি জমি বিক্রি করতে হয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিতে গিয়ে আগেই দুই বিঘা জমি বিক্রি করেছিলেন। এখন সংসারে বিঘা দুয়েক জমি থাকলেও এক বিঘা বন্ধক রেখে কফিল উদ্দিনের চিকিৎসা চলছে। বড় মেয়ে সেলাইয়ের কাজ করেন। তাঁর রোজগারে কোনোরকমে চলছে সংসার।
আম্বিয়া বেগম বলেন, ‘আলমগীর ছোটবেলায় ঋণের টাকায় কেনা গরু চরাত, ঘাস কেটে দিত। দুধ বিক্রির টাকায় পড়াশোনা করত। এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণের সামর্থ্য ছিল না। কানের দুল বিক্রি করে ওর হাতে কয়েক শ টাকা দিয়েছিলাম।’ ২০০৭ সালে পাঁচবিবি উপজেলার সরাইল উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন আলমগীর। এসএসসিতে মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ ৪ পয়েন্ট ৫০ পেয়েছিল তিনি। এইচএসসিতেও ভালো করেন তিনি।
আলমগীর হোসাইন বলেন, ‘মেসে রেখে শহরের কলেজে পড়ানোর মতো আর্থিক অবস্থা আমার পরিবারের ছিল না। কিন্তু আমার খুব ইচ্ছা ছিল শহরের কলেজে ভর্তি হব। মা-বাবার তাতে সায় ছিল না। মনের দুঃখে একদিন রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে বগুড়া শহরে আসি। হাতখরচের সব টাকা দিয়ে সরকারি আজিজুল হক কলেজে ২০০৯-১০ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের মেসে থাকতাম। তিনিই টিউশনির ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রতি মাসে ৭০০ টাকা পেতাম। সেটা খাওয়া বাবদ চলে যেত।’
এভাবে এক বছর কষ্টে চলার পর স্নাতক প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় বিভাগে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে সেরা হন আলমগীর। তত দিনে তাঁর দৈন্যের কথা এক শিক্ষক জেনে যান। তিনিই নিজের বাসায় রাখলেন। সেই শিক্ষক বছর তিনেক পর বগুড়া ছাড়লে বিপদে পড়েন।
আলমগীর বলছিলেন, ‘তখন যেন দিশেহারা অবস্থা। মেসে উঠলাম। টিউশনি করে দেড় হাজার টাকা পেতাম। পুরোটাই মেসের খাবার খরচে চলে যেত। মেসভাড়ার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হতো।’ এর মধ্যে একটি বাসায় তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেন। থাকার জন্য ভাড়াটুকু বেঁচে যায়। এভাবেই পড়াশোনা শেষে শুরু হলো চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে ছুটে চলা।
সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞপ্তি দেখলেই আবেদন করতেন। ২০১৯ সালে টিউশনির টাকায় সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ৩৬টি পদে চাকরির আবেদন করেন আলমগীর। বেসরকারি স্কুল-কলেজে নিবন্ধন পরীক্ষাতেও উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। আলমগীর বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন দপ্তর ও বাণিজ্যিক ব্যাংকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেও অজ্ঞাত কারণে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ পড়ে যেতাম।’
২০২০ সালে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে সবকিছু বদলে গেল। আলমগীরের টিউশনিও বন্ধ হলো। চাকরির আশায় ঢাকায় এলেন। উঠলেন এক বন্ধুর মেসে। কিছুদিন সেখানে থেকে চাকরি খুঁজলেন। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে একের পর এক সাক্ষাৎকার দিয়েও চাকরি জুটল না। বাধ্য হয়ে কাজ নিলেন পোশাক কারখানায়। বেতন মাস শেষে ৮ হাজার টাকা।
আলমগীরের গল্প এগিয়ে চলে, ‘কয়েক দিনের মাথায় দিনের বদলে রাতের পালায় ডিউটি পড়ল। চাকরির প্রস্তুতির পড়ার সময় পেতাম না, পরীক্ষার দিনও ছুটি পেতাম না। বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে বগুড়া শহরে ফিরলাম।’ যে বাসায় তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থাকতেন, সেখানে থাকার ব্যবস্থা হলো। রাতের খাবারের বিনিময়ে একটি টিউশনির ব্যবস্থা করলেন।
কিন্তু অন্য দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হবে কীভাবে? বাধ্য হয়ে ২১ জানুয়ারি ‘দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’ লেখা বিজ্ঞাপনটি বিভিন্ন জায়গায় সেঁটে দেন। অমিক্রন সংক্রমণের কারণে পরদিন স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। টিউশনির জন্য কোনো সাড়া না পেলেও ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের ছবিটি ভাইরাল হয়ে যায়।
বিজ্ঞাপনটি দেখে ফেসবুকে কেউ কেউ বিরূপ মন্তব্য করছেন, ফোন করে উল্টাপাল্টা কথাও বলছেন আলমগীরকে। তিনি বলেন, ‘আসলে যার ঘা, তারই ব্যথা। সাত মাস ধরে এক বেলা খেয়ে দিন যাচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালা সইতে না পেরে একান্ত বাধ্য হয়েই এই বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’
ফেসবুকে বিজ্ঞাপনটি ভাইরাল হওয়ার পর বগুড়ার একটি চাইনিজ রেস্তোরাঁর মালিক কোনো শর্ত ছাড়াই দুবেলা খাবার এবং প্রতি মাসে অর্থসহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু আলমগীর চান ভালো একটা চাকরি। তাঁর কথায়, ‘মা-বাবার বয়স হয়েছে। পরিবারের দায়িত্ব নিতে চাই।’