দিনের বেলায়ও লোকালয়ে ছুটে বেড়ায় বন্যহাতি

‘পাঁচ বছর আগেও বন্যহাতির এমন উত্পাত ছিল না; কদাচিত্ রাতের বেলায় লোকালয়ে এসে কলাগাছ ও ধান খেত। এখন দিনের বেলায়ও হাতি ঘুরে বেড়ায় লোকালয়ে। খাদ্যের অভাব ও আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রাণীটির এমন দুর্গতি হয়েছে।’ কথাগুলো বললেন চকরিয়ার খুটাখালী ইউনিয়নের হরিখোলা গ্রামের শহিদুল আলম (৫০)। বাবা আজিজুল হকের হাত ধরে ৪৭ বছর আগে এখানে বসতি গড়েছেন। তখন ছিল গহিন বন। বনে ছিল পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ। তখন কেউ কারও ক্ষতি করত না। তাঁর মতে, ১৫ বছর আগেও এই গ্রামে বাঘ এসে গরু খেয়েছে। ঝাঁকে ঝাঁকে হরিণ এসে জলাশয়ে পানি খেত। এসব এখন স্মৃতি। তিনি বলেন, ‘একসময় হাতি ছিল, আমাদের বন্ধু। যেখানে হাতি থাকত, সেখানে বাঘের আক্রমণ কম ছিল। সেই হাতি এখন আমাদের মারে, ঘর-বাড়ি ভাঙে। কেন এমন হচ্ছে?’ পাশে থাকা আজিজুল হক (৩৫) জানান, ‘নির্বিচারে বন উজাড় ও পাহাড় দখল হয়ে যাওয়ায় প্রাণীগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। এখনো অনেক বন্যপ্রাণী আছে, যেগুলো মাঝেমধ্যে লোকালয়ে ছুটে আসছে।’সরেজমিনে দেখা যায়, হরিখোলা গ্রামের পাশেই বয়ে গেছে খুটাখালী ছড়া। ছড়ার দুইকূলে বিস্তীর্ণ বন। পশ্চিম ও দক্ষিণে ন্যাড়া পাহাড়। পূর্ব-উত্তরে বিশাল গর্জনের বাগান। এ বাগানে পাখপাখালির কলতান। দুই ঘণ্টা বনে অবস্থান করে দেখা মেলে ছয়-সাতটি বন্যহাতির। ছড়ার পাড়েই একদল কৌতূহলী নারী-শিশু হাতিগুলো দেখতে ভিড় জমিয়েছেন। গ্রামবাসী জানান, প্রায় সময় হাতি ছড়ায় এসে কিছুক্ষণ শরীরটা পানিতে ভিজিয়ে আবার চলে যায়। জানা গেছে, চকরিয়া ও লামা উপজেলার পাহাড়ি গ্রামগুলোয় এখন বন্যহাতি নিয়মিত লোকালয়ে ছুটে বেড়ায়। প্রতিদিন কোনো না কোনো গ্রামে খাবারের খোঁজে ঢুকে পড়ছে। খুটাখালী, ডুলাহাজারা, ফাঁসিয়াখালী, মানিকপুর-সুরাজপুর, কাকারা, বরইতলী, হারবাং ইউনিয়ন এবং লামা উপজেলার আজিজনগর ও ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে বন্যহাতি দিনে ও রাতে ঢুকে পড়ে। এতে বাধা পেলে হাতির পাল হামলা চালায়। গত দেড় মাসে লামার ফাইতং এলাকায় পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। আর এসব এলাকায় ঘরবাড়ি ভাঙচুর হয়েছে শতাধিক। দুই মাস ধরে হাতির আক্রমণ ও উত্পাত ঠেকাতে এসব এলাকার মানুষ রাত জেগে পাহারা বসিয়েছেন। কেউ কেউ রাতের বেলায় পাহাড়ি এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। গাছের ওপরে টং বেঁধে কৃষকেরা মশাল নিয়ে রাত জাগছে। মানিকপুর বিটের কর্মকর্তা আবদুল হক হাওলাদার জানান, তাঁরা কয়েকবার ফাঁকা গুলি ছুড়ে হাতি তাড়িয়েছেন। এ বছর হাতির উত্পাত বেড়ে যাওয়ায় বনে টহল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) এএসএম জহির উদ্দিন জানান, মূলত সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে হাতি গর্ভবতী হয়। গর্ভবতী হাতির প্রচুর খাবার প্রয়োজন হয়। আর সেই খোঁজে বের হলে, কোথাও প্রতিবন্ধকতা পেলে সেখানে হামলা চালায়। তিনি জানান, মিয়ানমারের পাহাড় থেকে চট্টগ্রামের বাঁশখালী পর্যন্ত বিচরণ ছিল হাতির। এখন এসব পাহাড়ে মানুষের বসতি। বন উজাড়, খাল ও ঝিরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় হাতির আবাসস্থল ও খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়েছে।