কিছুদিন আগেও এটা প্রেমের গল্প ছিল না।
তবে শুরুটা প্রেমের ছিল। মেধাবী ছেলে। জীবনে ঘাড় ঘুরিয়ে পরীক্ষার হলে বন্ধুর খাতা দেখেনি। সেই অভ্যাস বড় হয়েও রয়ে গেল। তাই ঘাড় ঘুরিয়ে কোনো মেয়ের দিকেও আর তাকানো হলো না। সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের সেই সেন্ট লেনিন ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড, ইন্টারে স্ট্যান্ড। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা ডাক্তার। প্রোফাইলই জয় করে ফেলল মেয়েটার মন। বন্ধুদের সঙ্গে মজা করে এক-দুই দিন ফোনকল দিল মেয়েটি, ‘দেখি তো ভালো ছাত্রটি কতটা ভালো।’
ভালো ছেলেটি ভালো ছিল। ভালো না বেসে পারা গেল না। একটা সোয়েটার বুনতে যে সময় লাগে, তার চেয়েও অল্প সময়ের মধ্যে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে জীবনে কোনো পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়নি। বোন ডাক্তার, বাবা ডাক্তার, মা শিক্ষক। পাত্রীও সমানে সমান। বাঙালি বাবা-মায়ের যতই ইচ্ছা থাকুক, এই বিয়েতে অমত করার সাধ্য কী। বিয়ে হয়ে গেল।
কিন্তু এই ভালো ছেলে নিয়ে তো মহাবিপদ। আজ এফসিপিএস তো কাল এমআরসিপিএস। ছাব্বিশ অ্যালফাবেট শেষ হয়ে যায়, তার পড়া শেষ হয় না। বিয়ের আগে মায়ের নেওটা ছেলেটাকে তো ভালোই লাগছিল কিন্তু এখনো এই মায়ের কোলে কোলে থাকা তো আর ভালো লাগছে না। ম্যানস নাই, রোমান্স নাই। শ্বশুরবাড়ি এক রাত থাকবে না। কারণ, ‘মা একা’। কোনো দাওয়াতে শামিল হতে পারবে না। কারণ, ‘বড্ড পড়ার চাপ’। মেয়েটি একা, একাই দাওয়াতে যাওয়া শুরু করল। ‘জামাই আসে নাই? লেনিন আসে নাই? লেনিন ভাই আসবে না?’ শব্দগুলোর তাপ আস্তে আস্তে কমে আসতে লাগল। একজন নবীন ডাক্তারের উপযুক্ত স্ত্রী হয়ে উঠল সে ক্রমেই।
মেয়েটি বিদেশি ব্যাংকে চাকরি করে। চুল পাকার আগেই ব্যাংকের ‘হাই-ভ্যালু’ কাস্টমার সকলে। শুধু সেন্ট লেনিনেরই মাপা আয়ের সবটুকু ব্যয়। দেশের সফল প্লাস্টিক সার্জন সে অথচ প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে না। ছেলের বাবার গড়া বাড়িটা না থাকলে কোথায় যে ঠাঁই হতো, কে জানে। এ কেমন জীবন?
বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর কথাটা কী ভাবে সে? নিজের বিদেশি ব্যাংকের চাকরিটা না থাকলে এই লাখ টাকার স্পেশাল চাইল্ডটার কী হতো? ছোট ছেলেটার ইংরেজি মাধ্যমের পকেটকাটা টাকাগুলো কোত্থেকে আসত, কে জানে?
কিন্তু জানেন, মেয়েটির কোনো দিন রাত জাগতে হয়নি। তাদের স্পেশাল আদুরে ছেলেটা সারা রাত জেগে থাকে। বাবাও রাত জাগে তার সঙ্গে। সকালে তাই সে দেরি করে কাজে যায়। কিন্তু দেশকে ঠকায় না। সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে বাড়ি ফিরে সে। রাতের সময়টা কাজে লাগায় ঘর গুছিয়ে। মেয়েটি অফিস করে হেডফোন ফেলে রাখে বিছানায়। ছেলেটি তারগুলো ভাঁজে ভাঁজে সাজায়। মেয়েটি বলে, ‘ওসিডি আছে তোমার।’ ছেলেটি হাসে। বলে, ‘আপনি ঘুমান, কালকে অফিস আছে।’ কথা শেষ হয় না। মেয়েটি ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু সেন্ট লেনিন ঘুমায় না। ছেলের ঘুমের জন্য সানন্দে অপেক্ষা করে। যেন ভীষণ ব্যস্ততা তার, রাতজুড়ে এইভাবে ঘর গোছায় সে। কখনো কখনো মেয়েটির দিকে তাকায়। মিষ্টি একটা মেয়ে হঠাৎ কীভাবে তার বউ হয়ে গেল। লেনিনের সবকিছু নতুন মনে হয়।
ডায়াবেটিস ছিল লেনিনের। তবু বার্ন ইউনিটের একেকটা পোড়া মুখ তাকে বাড়িতে থাকতে দেয়নি করোনাকালে। অবশেষে দশ মাস পর ঠিক ঠিক করোনা তাকে জাপটে ধরে। বাড়িতে শুয়ে থাকতে থাকতে যখন হাসপাতালে ভর্তি হতেই হলো তাকে, তত দিনে ৯০ শতাংশ জং ফুসফুসে। চা না খাওয়া, সিগারেট না খাওয়া মায়ের ‘ভালো ছেলে’ লেনিন বিশ দিন ধরে কৃত্রিম হাই ফ্লো অক্সিজেন নিয়ে শ্বাস নিল।
মেয়েটির হাতটা পড়ে বিছানায়। খালি পাশটা খাঁ খাঁ করে। সেন্ট লেনিন তার বিছানাটা এতখানি দখল করে ছিল, কোনো দিন টের পায়নি মেয়েটি। লেনিন মেয়েটির অফিসের ফ্লাস্কে পানি ভরে রাখত। কে না কে পানি ভরবে৷ আট মাস দরজা বন্ধ করে অফিস না করে এক বিকেলে যদি এক কাপ চা নিয়ে বসতে দুজন!
কই, কোনো দিন তো মনে হয়নি লেনিনের গায়ের গন্ধে এমন মাদকতা। মাতাল শরীর নেশা না পেলে যেমন পাগল হয়, কেন লেনিন ছাড়া ঠিক তেমন লাগছে মেয়েটির। মেয়েটি লেখে, ‘আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে, কত দিন তোমাকে দেখি না৷’ লেনিন লেখে, ‘আমারও বুক ফেটে যায়, কত দিন আপনাকে দেখি না।’
লেনিনের ছবি প্রথম প্রেম হয়ে আসে আরও একবার। গোলাপি শার্ট পরা ছেলেটাকে স্বপ্নের রাজপুত্তুর মনে হয়। এইবার লেনিন বাড়ি ফিরুক, ‘আর ঝগড়া করব না আমি। শুধু লেনিন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরুক, সেন্ট লেনিন দম নিক।’
‘আপনি বুঝলেন না, আমি আপনাকে কত্ত ভালোবাসি’—এই শেষ কথাটা বলা কি খুব জরুরি ছিল? এক যুগ তো এই কথাটা না জেনেই কেটে গেল। না বুঝেই কেটে গেল। এখন যে আর কাটছে না দিন মেয়েটির।
কে যেন ‘পেনসিল’ গ্রুপে মাত্র একটা গান পোস্ট দিল। মেয়েটি চোখের পাতা ভরা রং-ভারী কাজল মেখে হাসিমুখে গাইছে শ্যামল মিত্রের গাওয়া গান, ‘তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা/ কে বলে আজ তুমি নাই/ তুমি আছ মন বলে তাই।’