বাবার অকালমৃত্যু, বাল্যবিবাহ, স্বামীর বেকারত্ব, বেসরকারি কোম্পানির প্রতারণা ও ব্যবসা করতে গিয়ে তহবিল খোয়ানো—৩০ বছরের জীবনে কম ঝড়ঝাপটা যায়নি। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে আত্মহত্যার চিন্তা পর্যন্ত করেছিলেন মাহবুবা আক্তার জাহান। তাঁর ডাকনাম বাঁধন। হঠাৎ তাঁর চোখ খুলে দেয় ঝালমুড়ির মসলা। নিজের উদ্ভাবিত ঝালমুড়ির মসলা দিয়ে যে ব্যবসা একদিন শুরু করেছিলেন, সেই প্রতিষ্ঠানই এখন সরবরাহ করে ৩৬ পদের পণ্য। গত দেড় বছরে তাঁর ফেসবুক পেজ ‘বাঁধন ফুড’ থেকে বিক্রি হয়েছে ৭৫ লাখ টাকার পণ্য।
এই অদম্য নারীর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার বজরাপুর গ্রামে। তাঁর স্বামীর নাম মসির উদ্দিন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ ও এমবিএ করে দুই বছর একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে এখন ‘বাঁধন ফুড’-এর সার্বক্ষণিক কর্মী হয়ে গেছেন। গ্রামের কয়েকজন দুস্থ নারীরও তাঁর মাধ্যমে কর্মসংস্থান হয়েছে। মাহবুবা এখন নারীদের অনলাইন ব্যবসার প্ল্যাটফর্ম ‘উই’-এর রাজশাহী প্রতিনিধি। ২০২০ সালের মার্চ মাসে এই ফেসবুক গ্রুপে প্রথম পোস্ট দিয়েছিলেন তিনি। আর গত জুনে তাঁকে রাজশাহী প্রতিনিধি ঘোষণা করে উই।
বজরাপুর গ্রামে তাঁর শ্বশুরবাড়িতে মাহবুবার সঙ্গে কথা হলো। উপস্থিত ছিলেন তাঁর স্বামীও। মাহবুবা বললেন, তাঁর বাবা একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। ২০০৭ সালে অকালে মারা যান। তখন তিনি অষ্টম শ্রেণিতে পড়তেন। বাবার মৃত্যুর পাঁচ মাসের মধ্যে তাঁর বিয়ে হয়ে যায়। তখন তাঁর স্বামী সদ্য এসএসসি পাস করেছেন। বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে দুই ছেলেমেয়ে হলো। তারা একটু বড় হলে ২০১৩ সালে ছোট বোনের সঙ্গে আবার নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন মাহবুবা। একে একে এসএসসি, এইচএসসি। মাহবুবা এখন পবার হাটরামচন্দ্রপুর ডিগ্রি কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
সংসারের পাশাপাশি আয়বর্ধক কিছু করার চিন্তা করেন। খুশি হয়ে তাঁর শাশুড়ি রমেসা বেগম তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় এক লাখ টাকা ছেলের বউয়ের হাতে তুলে দেন। এই টাকা মাহবুবা একটি বেসরকারি সংস্থায় বিনিয়োগ করেন। তারা টাকা মেরে পালিয়ে যায়। ২০১৬ সালে অন্যের দেখাদেখি বুটিক নিয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যবসা হলো না, উল্টো তাঁর ২০ হাজার টাকার পুঁজি বসে গেল।
এ সময় চরম হতাশ হয়ে পড়েন তিনি। শুধু মনে হতে থাকে বেঁচে থেকে কী লাভ। মাথায় আত্মহত্যার চিন্তা আনাগোনা করতে থাকে। হতাশা ভুলে থাকার জন্য বাসায় বসে শুধু ফেসবুকে বিভিন্ন গ্রুপের ব্যবসার খবর দেখেন। এ সময় রাজশাহীতে একটি গ্রুপের ‘গেট টুগেদার পার্টি’র খবর চোখে পড়ে। সেখানে তিনি যোগ দেন। গ্রুপের অ্যাডমিন লায়লা নাজনীনের জন্য নিজের বাসায় তৈরি দুই কেজি খেজুরের গুড় নিয়ে যান। তারপর হঠাৎ একদিন দেখেন গ্রুপে তাঁর গুড়ের রিভিউ দিয়েছেন লায়লা। বলেছেন, কারও খেজুরের খাঁটি গুড়ের দরকার হলে বাঁধনের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সে সময় ২৭ কেজি গুড়ের ফরমাশ এল। কিন্তু এত গুড় তো তাঁর কাছে নেই। লায়লা ফোন করে বললেন, যেভাবে হোক, এই গুড় আপনাকে দিতেই হবে, না হলে গ্রুপ থেকে আপনাকে বের করে দেব।’ বাধ্য হয়ে গুড় সরবরাহ করলেন। সেবার তাঁর ২৫০ কেজি গুড় বিক্রি হলো। এবার অ্যাডমিন বললেন, ‘নতুন কিছু করুন, যা কেউ করেনি।’ ভেবে ভেবে নিজের হাতে নতুন স্বাদের ঝালমুড়ির মসলা তৈরি করলেন। একটা গ্রুপে দিলেন। লোকজন গালাগাল দিতে লাগল। অধিকাংশেরই এক কথা, মানুষের খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই যে অনলাইনে অর্ডার করে ঝালমুড়ির মসলা কিনবে! এটা কি কোনো খাদ্য হলো? মাহবুবা বললেন, ‘সেই রিভিউগুলো ছিল খুবই হতাশাজনক।’ তিনি ভেঙে পড়েছেন।
এরই মধ্যে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পূর্বাচলে ‘উই কালারফুল ফেস্ট’-এর আয়োজন হচ্ছে শুনে সেখানে এই ঝালমুড়ির মসলা নিয়েই হাজির হলেন মাহবুবা। তাঁর স্টলে এসে প্রথম মসলা কিনলেন ইনোভেশন ফোরামের উপদেষ্টা আরিফুল হাসান। তাঁকে দেখে সচিব মুজিবুল হকও কিনলেন। তারপর কী যে হলো, প্রথম দিনেই ১০ কেজি মসলার সবটাই শেষ হয়ে গেল। না পেয়ে আরও মানুষ অর্ডার দিলেন। বাড়িতে এসে সরবরাহ করতে থাকলেন। চমৎকার সব রিভিউ আসতে থাকল। তখন রমজান মাস। এক মাসে তিন লাখ টাকার মসলা বিক্রি হয়ে গেল। এই ঝালমুড়ি বিক্রির সুবাদে উই গ্রুপে তাঁর ব্যাপক পরিচিতি হলো। অন্যান্য পণ্যেরও ফরমাশ আসতে থাকল। শর্ষের তেল, কুমড়া বড়ি, খেজুরের গুড়—সবই বিক্রি হতে থাকল।
এমনকি তাঁর পেজ থেকে গরু-ছাগল পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। তখন ঘোর করোনাকাল। কোরবানি ঈদে গরু-ছাগলের হাটে ক্রেতা নেই। ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে এলেন। তিনি অনলাইনে ১৯টা গরু, ৮টা ভেড়া ও ১৬টা ছাগল বিক্রি করে দিলেন। মাহবুবা বললেন, এ সময় লোকজন তাঁকে গরুর দালালও বলেছেন।
মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে ঢাকার ক্রেতা প্রিমা তাসনিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বাঁধন আপুর কাছ থেকে অনেক পণ্যই নিয়েছি, তার মধ্যে ঝালমুড়ির মসলাই বেশি কিনছি। এটা তো পপুলার হয়ে গেছে। আমাদের পরিচিত অনেকেই কেনেন।’