২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

জোনাকি পোকা

অনেক দিন হল আমি জোনাকি পোকা দেখিনি। প্রবাসী হওয়ার পর আমি মনে হয় যন্ত্র হয়ে গেছি। খাওয়া, ঘুম আর কাজ এইসবের মাঝেই মিশে আছি বলা যেতে পারে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটা কথা বার বার মনে পড়ে,

"হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করিয়াছ মহান"

আমি মহান নই, মহান হওয়ার ইচ্ছেও নেই। "দারিদ্র্য" শব্দের সাথে "ক্ষুধার্ত" শব্দটার মিল আছে। প্রচন্ড ক্ষুধায় যখন কষ্ট পেতাম, তখন "মহান" বলে যে একটা শব্দ আছে, তার কথা আমার মনে থাকত না। আমার প্রিয় কবিকে বলতে ইচ্ছে করত, "হে মহামান্য কবি, আপনি কি ভেবে দারিদ্র্যকে এত্তো ওপরে তুলে ধরেছেন?" আমার বিদেশ আসার সুযোগ হয়। আমি হয়ে যাই প্রবাসী.....।

প্রবাসী হওয়ার পর থেকেই আমার মাঝে দেশপ্রেম সৃষ্টি হয়। আমার হৃদয় দর্পণে প্রতিনিয়ত ভেসে উঠে আবহমান বাংলার নানান রূপ। একাকীত্বের আগুনে আমি দাউ-দাউ করে জ্বলতে থাকি।

জোনাকি পোকার কথা বলছিলাম। কিছুদিন ধরে জোনাকি পোকার কথা বারবার মনে পড়ছে.......

ছোটবেলায় বাবার সাথে একবার গভীর রাতে গ্রামের বাড়ি রওনা হয়েছিলাম। আমরা যেখানে থাকতাম সেখান থেকে আমাদের গ্রামের বাড়ি তেমন একটা দূরে না। তারপরও আমার ভয় ভয় করছিল (ভূতের ভয়)। জোস্না ছিল না, কিন্তু তারপরও চাঁদের সামান্য আলোয় রাস্তায় আমাদের ছায়া পড়েছিল। আমার মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াটাই হয়ত ভূত। আমাদের গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুতের আলো সেই সময় পৌঁছায়নি, তাই বাড়িগুলোকেও ভূতের বাড়ি মনে হচ্ছিল। আমি আব্বুর হাতের দিকে চেয়ে চেয়ে পথ চলতে থাকলাম। এই অন্ধকার ভূতের বাড়িতে আমি থাকব কিভাবে, সেটা ভেবে আমার রক্ত শীতল হতে হতে হয়ত জমতে শুরু করেছিল। আব্বু হঠাৎ বললেন, "চেয়ে দেখ কত্তো জোনাকি"।

জোনাকি পোকা দেখার শখ আমার নেই, তারপরো দৃষ্টি দিলাম বাড়ির পাশের ঝোপের দিকে। ছোট ছোট পোকা গায়ে মিটিমিটি সবুজ আলো নিয়ে ঘুরছে, সে আলোতে তীব্রতা নেই। জোনাকি পোকা নিয়ে কয়েকটা গল্প-কবিতা পড়েছি, কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি এই পোকা এতো সুন্দর হবে। আমার শিশু মনের সব ভয় ক্ষণিকেই দূর হয়ে যায়। আমার তখন মনে হচ্ছিল, হাজার হাজার প্রহরী প্রদীপ নিয়ে আমাদের গ্রামটাকে পাহারা দিচ্ছে। আব্বু একটু পরেই ভেজা গলায় আমাকে ফিসফিস করে বললেন, "অনেক বছর পর আজ আবার একসাথে এতো জোনাকি পোকা দেখলাম"।

বাবার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম, জোনাকি পোকা বাবার খুবই ভালো লাগে তা বুঝলাম, কিন্তু চোখে জল আসার কারণ বুঝতে পারিনি সেই সময়। আমার মনে আছে, সেই আলোবিহীন রাতও আমার বাবার চোখের জলকে আড়াল করে রাখতে পারেনি।

আমার অবচেতন মন, ছোটবেলার সেই মধুময় স্মৃতি আমার নিউরনের মাঝে যত্নে তুলে রেখেছিল। সে রাত এখনো আমার হৃদয় দর্পণে ছবির মতো ভেসে উঠে।

দারিদ্র্যের শক্ত শিকল আমার পায়ে বাঁধা। আমি এখন আশায় প্রহর গুনছি, একদিন আমার পায়ে বাঁধা এই শক্ত শিকল ছিঁড়ে যাবে। আমি তখন ছোটবেলার সেই রাতের মতো আরেকটা রাত বেছে নিয়ে গ্রামের বাড়ি যাব। আমি একসাথে অনেক জোনাকি পোকা দেখে কিছুক্ষণ কাঁদব।

লন্ডন,ইংল্যান্ড

(লেখার আই.ডি : ১৫)