বাংলাদেশের মানচিত্রের নিচের দিকে কতগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া বিন্দুবৎ গোল্লা গোল্লা যে দাগ দেখা যায়, এর সব শেষেরটির নাম ছেঁড়া দ্বীপ।
খবর নিয়ে জেনেছিলাম—ছেঁড়া দ্বীপে থাকা–খাওয়ার কোনো জায়গা নেই। সেন্ট মার্টিনের মূল ঘাট থেকে ৫ কিলোমিটারের মতো পথ। কেউ কেউ ছেঁড়া দ্বীপের কাছাকাছি জায়গা পর্যন্ত ভ্যানগাড়িতে হেলেদুলে যেতেও পারেন, কিন্তু সেটা খুব সুবিধার নয়। সুবিধার রাস্তা হচ্ছে সাগরের বুক চিরে যাওয়া। তাতে সাগরটাও দেখা হয় সহজে, যাওয়াও যায় কম সময়ে।
নৌকা ঘাটে যেতেই দেখা মেলে এক টং দোকানের। এখানে সারি সারি ডাব-নারকেল ঝুলিয়ে রাখা। আছে চা-বিস্কুট খাওয়ার বন্দোবস্তও। আর আছে কিছু চিপসের প্যাকেট ঝোলানো। ডানে-বাঁয়ে বা সামনে এই আধা কিলোমিটারের ওপর আছে বালু আর খাঁজকাটা খাঁজকাটা কিছু পাথর। পাথরের গায়ে লাগা শৈবাল যা সমুদ্রের গহিনে হাজার হাজার বছর জমে থেকে কঠিন পাথুরে রূপ ধরে বসে আছে, তারই কতগুলো পা দিয়ে মাড়াতে মাড়াতে একসময় আমরা আরেকটি উঁচু জায়গায় গিয়ে দাঁড়াই।
এবার দেখি সামনে–পেছনে আর বাঁয়ে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। ডানেও সমুদ্র আছে, কিন্তু সেখানে কিছু লোকালয়ও আছে। সমুদ্রকে একেবারে ২৭০ ডিগ্রিতে আঁকড়ে ধরার মতো এত সুন্দর জায়গা পৃথিবীর আর কোথায় আছে, আমি জানি না।
খানিক পরই টের পাই, এখানে যেকোনো জায়গায় পশ্চিম দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লে সূর্য ডোবা দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়া যাবে। আবার এই জায়গায় সারা রাত ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভেঙে পূর্ব দিকে মুখ করে থাকলে বিছানায় শুয়ে শুয়েই পুবের সাগর থেকে ডিমের কুসুমের মতো ভেসে ওঠা সূর্যটাও দেখা যাবে।
আমার খুব ইচ্ছা করল সেখানে থেকে যেতে। আমার সঙ্গে জেনারেল পাশা, তাঁর স্ত্রী আর দুই কন্যা। পাশাকে বলি, ‘তুমি ভাই তোমার বাহিনী নিয়ে চলে যাও, আমি থেকে যাচ্ছি।’
হাসে পাশা। সে তাঁর কর্ডকে ডেকে মুচকি হেসে বলে, ‘তোমরা শাকুর ভাইয়ের জন্য এখানে বিছানা পাতার ব্যবস্থা করে দাও। তিনি এখানেই আজ রাত্রিযাপন করতে চান।’
বেচারা কর্ড মনে করেছেন, সত্য সত্যই বোধ হয় আমি রাতে থেকে যেতে যাচ্ছি। খানিক ঘোরাঘুরি করে এসে বলেন, আমি খোঁজ নিয়ে এসেছি, এখানে আসলে থাকার কোনো নিয়ম নেই। সবাইকে বিকেল চারটার মধ্যে এই দ্বীপ ছেড়ে যেতে হয়।
এ তো দেখি মহা বেড়াছেড়া জায়গারে ভাই! এলাম প্রাণভরে সমুদ্র দেখতে, এখানে এত বিধিনিষেধ কেন?
খোঁজ নিই এলাকাটির। মাত্র চার একর জায়গাজুড়ে এই দ্বীপ বছরে চার কি পাঁচ মাস মাত্র জেগে থাকে। ভরা বর্ষার মৌসুমে সাগরের তলায় ডুবে যায় আধা কিলোমিটার লম্বা বালু-পাথরের দ্বীপটা। এখানে কতগুলো কেওড়াগাছ জন্মে, আর কিছু না। সাগরের পানির তলায় বা ওপরে কিছু বালুর সঙ্গে মাখামাখি করে থাকে প্রবাল আর শৈবালের পাথর। আছে কিছু সুন্দর সুন্দর শামুক আর ঝিনুক। কিন্তু এগুলো এখান থেকে নেওয়া বা কেনাবেচা—দুই-ই নিষিদ্ধ।
দ্বীপে দু–তিনটা অস্থায়ী দোকান আছে। দোকান মানে—কতগুলো খুঁটির ওপর পলিথিন বিছিয়ে ছাদ। দোকানিরা সকালবেলা পাশের লোকালয় থেকে এসে এখানে দোকান পাতে, আর বিকেল গড়াতেই সবকিছু নৌকা করে নিয়ে চলে যায়।
হঠাৎ চোখ গেল একটা ঘরের ভেতর। শুনে অবাক হই, সব নিয়ম ভেঙে এখানে একটিমাত্র পরিবার রাতে থাকে। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা আছে এখানে। দ্বীপ ডুবে যাওয়ার আগে চলে যায়, আবার দ্বীপ ভেসে উঠলে তারা এখানে এসে থাকে। এই ঘরের পাশের চা-বিস্কুটের দোকানটি তারা চালায়। তার পাশে পলিথিনের বেড়া দিয়ে আটকানো একটা টাট্টিখানা। তাঁদের জন্য না হয় হলো, অভ্যাগত অতিথির খুব দরকার হলে এখানে এসবের কোনো ব্যবস্থা নেই।
আমার সহযাত্রীদের কাউকেই একসময় আমি কাছে দেখি না। তারা দূরে চলে গেছে ফটোসেশনে। পাশা তাঁর স্ত্রী আর দুই কিশোরী যমজ কন্যা আনিকা আর আনুষ্কাকে নিয়ে ফটোসেশনে ব্যস্ত। সমুদ্রের সঙ্গে মিল রেখে তারা পড়েছে নীল রঙের জামা।
আমি টি-স্টলের একটা বেঞ্চির ওপর বসে ডাব খাই। যদিও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে নারকেলগাছেরই জয়জয়কার, তবু এখানে ডাবের দাম ঢাকার চেয়ে বেশি। হঠাৎ দেখি ঢাকা থেকে আসা এক দঙ্গল তরুণ-তরুণী একটা হিন্দি গানের সঙ্গে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছে। দেখি একজনের পকেটে আছে একটা সাউন্ড বক্স, সে এখান থেকে গান ছাড়ছে, আর দলের ছেলেমেয়েরা নাচ শুরু করে দিচ্ছে। মজার ব্যাপার, এ রকম ঢোলের বাড়ি শুনে বেড়াতে আসা নাচুনে বুড়ি দু-একজনকে দেখি অবলীলায় সমুদ্র সামনে রেখে নাচ শুরু করে দিয়েছে।
আমি তাঁদের ছবি তুলতে শুরু করে দিই। এই আয়োজন দেখে ভিড় লেগে যায়। একসময় পাশারাও এসে দাঁড়ায় পাশে। তাঁর কর্ড শামিম এসে বলে, ‘আপনার জন্য কাঁকড়া গ্রিল করা হচ্ছে। খাবেন তো?’
‘আরে, বলে কী!’
দেখি দোকানের পাশেই একটা ড্রামের ভেতর পানিতে সাঁতরাচ্ছে বেশ বড় বড় কাঁকড়া। একেকটা ৫-৬ ইঞ্চি লম্বা। তেলে ভেজে গ্রিল করে দেবে। প্রতি পিস ৬০ টাকা। সস্তা তো!
আমরা কিছু কাঁকড়া খেয়ে এবার দুপুরের খাবারের জন্য আঁকুপাঁকু করতে থাকি। শামিম খবর নিয়েছেন, ছেঁড়া দ্বীপের পাশেই সেন্ট মার্টিনের শেষ প্রান্তে মিউজিক ইকো রিসোর্ট নামে একটা চমৎকার রিসোর্ট আছে। সেখানে দুপুরে খাওয়া আর শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত দেখার ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে।
আমাদের ছেড়ে যেতে হবে এই ছেঁড়া দ্বীপ। আরেকবার এলে আর যাব না। শেষ বিকেল ওই জেলে পরিবারের সঙ্গে লুকিয়ে থেকে পুরোটা রাত ভরা জ্যোৎস্না আর ভোরের সূর্যোদয় দেখে, সারা দিন ওই ছাপরায় ঘুমিয়ে পার করার ইচ্ছা নিয়ে ছেঁড়া দ্বীপ ছেড়ে যাই।
শাকুর মজিদ: লেখক ও স্থপতি