খাগড়াছড়ির তরুণ তুফানের আঁকা ছবিতে উঠে আসে পাহাড়ের জীবন
শৈশবে বর্ণমালা লেখার চর্চা যখন শুরু, তখন থেকে লেখার চেয়ে ছবি আঁকাটাই বেশি টানত। টুকরা কাগজ, বইয়ের সাদা পাতা পেলেই পাহাড়ের কোলে, গাছের ছায়ায় বসে পড়তেন তুফান চাকমা। ছবি আঁকতেন। তাঁকে আঁকাআঁকির রসদ জুগিয়েছে গাছপালাঘেরা সবুজ পরিবেশ। শিল্পী হিসেবে গড়ে উঠতে প্রেরণা দিয়েছে পাহাড়ি গ্রাম।
আঁকাআঁকিকেই নিজের প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তুফান। সপ্তাহে অন্তত তিনটি ছবি আঁকেন তিনি, তুলে দেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে। দিনে দিনে এই আঁকাআঁকি তুফানকে দিয়েছে নিজস্ব পরিচয়। তাঁর ফেসবুক পেজের নাম—তুফানস আর্টবিন।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালার উদালবাগান গ্রামে বেড়ে ওঠা তুফান এখন পড়ছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে। মা, বাবা ও দুই ভাইকে নিয়ে তাঁদের ছোট্ট সংসার। বাবা অশ্বত্থামা চাকমা একজন কৃষক, নিজেদের প্রয়োজনীয় ফসল নিজেরাই উৎপাদন করেন। ছেলের পড়াশোনার খরচ জোগানোর সামর্থ্য বাবার ছিল না। তবে তুফান থেমে থাকেননি। তাঁদের বংশে তিনিই প্রথম, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখেছেন।
আঁকাআঁকিতে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, জানতেন না ছবি আঁকার ব্যাকরণ। উদালবাগানের স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে। এই সময়ে জেঠিমা পবিত্রা সরকারের বাসায় থেকে পড়াশোনা করতেন। তুফান চাকমা বলেন, ‘পড়াশোনার ফাঁকে যখন ছবি আঁকতাম, জেঠিমা খুব খুশি হতেন। ছবি আঁকার উৎসাহ দিতেন। এরপর দিন যত গেছে, ছবি আঁকার পরিধিও বেড়েছে।’
কলেজ পেরিয়ে ঢাকায় এলেন। বড় ভাই কনিষ্ক চাকমার বাসায় থেকে টিউশনি করে চলতে শুরু করলেন তিনি। ‘ঢাকায় আসার পর যতবার বাড়ি গিয়েছি, দেখেছি, পাহাড় আর আগের মতো নেই। ছোট্ট নির্মল পরিবেশে কারা যেন আঘাত করছে। আরও খেয়াল করলাম, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীদের নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে নানা রকম ভুলভাল ধারণা আছে,’ বলছিলেন এই তরুণ শিল্পী। কীভাবে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা যায়, কীভাবে মানুষকে পাহাড় আর পাহাড়ের বাসিন্দাদের সম্পর্কে সঠিক ধারণা দেওয়া যায়, ভাবছিলেন তিনি। একসময় আঁকাআঁকিকেই বেছে নিলেন তাঁর মনের কথা বলার মাধ্যম হিসেবে।
ধীরে ধীরে পাহাড়ের নিজস্ব সংস্কৃতি, কৃষ্টি-কালচার এঁকে নিজের ফেসবুক পেজকে সমৃদ্ধ করেছেন তুফান চাকমা। দেশ-বিদেশ থেকে প্রচুর সাড়াও পেয়েছেন। তুফান বলেন, ‘পাহাড় সম্পর্কে জানার আগ্রহ আছে মানুষের। কিন্তু এ সম্পর্কে জানার মতো ভালো বই, সিনেমা বা ছবি খুব বেশি নেই। তাই আমার আঁকা ছবিতে পাহাড়ের মানুষের জীবনটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি। ফেসবুক পেজে বার্তা দিয়ে, ই-মেইলে মানুষ প্রতিনিয়ত আরও বেশি আঁকতে উৎসাহ দিচ্ছেন।’ সম্প্রতি একটি নাটকের পোস্টার এঁকেছেন তুফান। নাম—এ দেখা না–ইবা হতো।
টিউশনির টাকা জমিয়ে কিনেছেন আইপ্যাড। এই প্যাডই এখন তাঁর আঁকাআঁকির নিত্যসঙ্গী। ডিজিটাল ফরম্যাটে আঁকা ছবিতে নিত্যনতুন উপায়ে পাহাড়কে তুলে ধরছেন তুফান। পাহাড়ি জীবনকে বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যতে ড্রয়িং অ্যান্ড প্রিন্টিংকে পেশা হিসেবে নিতে চান তুফান। অ্যানিমেশন বানানোর প্রতিও আগ্রহ আছে।
তুফান বললেন, ‘মাথার মধ্যে অনেক কাহিনি ঘোরে, সেগুলোকে ক্যানভাসে তুলে ধরতে চাই। পাহাড় সম্পর্কে অনেক কিছু জানার আছে। পাহাড়ি সংস্কৃতি অনেক সমৃদ্ধ। বাংলাদেশকে নিয়ে তো অনেক মানুষ কাজ করছে কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কাজ করার মানুষ খুব কম।’