কে-পপ যখন গবেষণার বিষয়

সারা বিশ্বের অসংখ্য কে-পপ (কোরিয়ান পপ) ভক্তের মধ্যে কাশফিয়া আরিফকে একটু আলাদা বলাই যায়। তিনি শুধু যে ভক্ত, তা নয়। কে–পপ তাঁর কাছে গবেষণার বিষয়। ঢাকার ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশে কয়েক বছর শিক্ষকতা করেছেন। এখন কাশফিয়া কানাডার অন্টারিও কলেজ অব আর্ট অ্যান্ড ডিজাইন ইউনিভার্সিটিতে ‘আর্টস ইন ক্রিটিসিজম অ্যান্ড কিউরেটোরিয়াল প্র্যাকটিস’ বিষয়ে স্নাতকোত্তর করছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

বাংলাদেশে নানা অনুষ্ঠান আয়োজন করেন কে–পপ ভক্তরা
ছবি: সংগৃহীত

আপনি যুক্তরাজ্যের সোয়াস ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে স্নাতকোত্তর করেছেন। থিসিসের বিষয় হিসেবে কে-পপ বেছে নেওয়ার পরিকল্পনা মাথায় এল কেন?

কাশফিয়া: মাস্টার্সে আমার থিসিসের বিষয় ছিল—‘ফ্যান্ডমস ইন কে-পপ: আ ক্রিটিক্যাল অ্যানালাইসিস অব দ্য ট্রান্সন্যাশনাল ফ্যান কালচার অব কে-পপ অ্যান্ড দ্য সোশ্যাল মিডিয়া’। যেহেতু ক্রিটিক্যাল মিডিয়া অ্যান্ড কালচারাল স্টাডিজ নিয়ে পড়েছি, শিক্ষকেরা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছিলেন, গবেষণায় ‘গণমাধ্যম’ ও ‘সংস্কৃতি’, এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় থাকতে হবে। ২০১৩ সালে যখন স্নাতকোত্তর করতে লন্ডনে যাই, বাংলাদেশে তখনো কে-পপের ভক্তের সংখ্যা হাতে গোনা। লন্ডনে যাওয়ার পর আমার মতো আরও বহু ভক্তের দেখা পেলাম, তখন আর দ্বিতীয়বার ভাবিনি।

কে-পপের কনসার্টের সঙ্গে অন্য কনসার্টের পার্থক্য হলো, এখানে ‘মোটামুটি ভক্ত’ বলে কেউ নেই। সব ভক্তই ১০০-তে ১১০!

গবেষণার কাজ সাধারণত খুব ক্লান্তিকর হয়। যেহেতু পছন্দের বিষয় বেছে নিয়েছিলেন, আপনার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা ব্যতিক্রম?

কাশফিয়া: অবশ্যই। বলতে পারেন আমি ‘পার্টি করতে করতে’ গবেষণা করেছি। কে-পপ কনসার্টে গিয়েছি। কে-পপ কনসার্ট যে কী, যিনি না গেছেন, তাঁকে বোঝানো সম্ভব নয়। সব কনসার্টেই খ্যাপাটে ভক্ত থাকেন। কে-পপের কনসার্টের সঙ্গে অন্য কনসার্টের পার্থক্য হলো, এখানে ‘মোটামুটি ভক্ত’ বলে কেউ নেই। সব ভক্তই ১০০-তে ১১০! আমি ডেটা কালেক্ট করার জন্য বিভিন্ন ‘ফ্যান মিট’-এ গিয়েছি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে যাঁরা কে-পপের ভক্তদের বড় বড় গ্রুপ পরিচালনা করেন, তাঁদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কোনো কোনো অনুষ্ঠানে তো এমনও দেখা গেছে—চারদিকে উঁচু ভলিউমে গান বাজছে, হইহুল্লোড় চলছে, আর আমি এক কোনায় বসে মানুষের সঙ্গে কথা বলছি, নোট নিচ্ছি। পুরো ব্যাপারটিই খুব উপভোগ্য ছিল।

বাংলাদেশে কে-পপের জনপ্রিয়তা নিয়েও তো আপনি গবেষণা করেছেন?

কাশফিয়া: মাস্টার্সের গবেষণাটা করেছিলাম ২০১৪ সালে। ২০১৬ সালে জাপানে একটা কালচারাল স্টাডিজ কনফারেন্সে গিয়েছিলাম। সেখানে কে–পপ নিয়ে আমার গবেষণার কথা তুলে ধরেছি। ২০১৭ সালে ইউল্যাবে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর বাংলাদেশি কে-পপ ফ্যান কমিউনিটির সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। মানুষ কেন কে-পপের ভক্ত হয়, এখন সেটা নিয়ে গবেষণা করছি। ও হ্যাঁ, ২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার একটা কালচারাল স্টাডিজ কনফারেন্সেও গিয়েছিলাম। সেখানে বাংলাদেশি কে–পপ ফ্যান কালচার নিয়ে কথা বলেছি।

কাশফিয়া আরিফ
ছবি: সংগৃহীত

গবেষণায় পাওয়া কোনো চমকপ্রদ বিষয় কি আমাদের জানাবেন?

কাশফিয়া: ভাষা বুঝি না, সংস্কৃতি মেলে না, তবু কে-পপের লিরিকের সঙ্গে ভক্তরা নাকি নিজেদের মেলাতে পারে। গুগল সার্চ করে মানুষ অর্থটা জেনে নয়। এমনকি অনেককে নাকি জীবনের কঠিন সময় পার করতেও এই গান সহায়তা করে। কারণ লিরিকে সে রকম ‘স্পিরিট’ ও ‘এনার্জি’ আছে। আরেকটা বিষয় হলো, ভক্তদের পরস্পরের মধ্যে বন্ধন। এটা একধরনের বিশ্বাস দেয় যে অন্যরকম হওয়া দোষের কিছু নয়। তাঁরা নিজের একটি জায়গা, একটি দল খুঁজে পান। ধরুন, আমাদের দেশে মানুষ ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার ভক্ত কেন হয়? কারণ, মানুষ একটি দলভুক্ত হতে চায়। একটি কমিউনিটির অংশ হতে চায়।

বাংলাদেশের ভক্তদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে কী পেলেন?

কাশফিয়া: কে কন, কে–পপ ফেস্টিভ্যাল, এ রকম বড় বড় আয়োজন বাংলাদেশে হয়। ফেসবুকে ভক্তদের একাধিক গ্রুপ আছে। আমার জানা মতে, আমাদের এখানে সক্রিয় কে-পপের ভক্তের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। ‘সক্রিয়’ বলতে বোঝাচ্ছি, যাঁরা ভক্তদের বিভিন্ন কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। ২০ হাজার সংখ্যাটাই অনেক বড়। কিন্তু এর বাইরেও আরও অনেকে আছে। যেমন শিশু-কিশোরদের একটি বড় অংশও এখন কে-পপের ভক্ত, যারা হয়তো সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নেয় না। কিন্তু তাদের সংখ্যাও কম নয়। দেশে কে–পপ ফেস্টিভ্যাল হলে দেখবেন ছোট ছোট অনেক বাচ্চা মা-বাবার হাত ধরে আসে। সুতরাং, এটা যে শুধু টিনদের পছন্দ এমন নয়। আরেকটি বিষয় আমি রিসার্চ করতে গিয়ে জেনেছি। আমার ধারণা ছিল কে-পপের ভক্তরা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। কিন্তু মোটেও তা নয়। বরং ঢাকার বাইরে কে-পপের ভক্তের সংখ্যা বেশি। এবং কেউ কেউ খুব ভালো নাচেন। অসম্ভব ট্যালেন্টেড ছেলেমেয়ে আছেন। এবং তাঁরা খুবই সক্রিয়। আমি আশা করব, এই চর্চা তাঁদের আরও মুক্তমনা করবে।