কৃষ্ণার গোলের তৃষ্ণা

কৃষ্ণা রানী সরকার। ছবি: শামসুল হক
কৃষ্ণা রানী সরকার। ছবি: শামসুল হক

ফেসবুকে নিজের প্রোফাইল নাম দিয়েছেন ‘কৃষ কুল’। সামাজিক মাধ্যমের এই নামের মতো বাস্তবেও তিনি অনেক শান্ত, ধীরস্থির এক মেয়ে। কৃষ্ণা রানী সরকার নামের এই শান্তশিষ্ট মেয়ের চেহারাই যেন বদলে যায় মাঠে নামলে। ফুটবল পায়ে শান্ত মেয়েটা হয়ে ওঠেন অশান্ত। প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে মেতে ওঠেন বুনো উল্লাসে। কৃষ্ণা রানী সরকার বাংলাদেশ জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৬ মহিলা দলের অধিনায়ক। একই সঙ্গে জাতীয় দলের অন্যতম বড় ভরসার নামও।
কৃষ্ণার বাবা বাসুদেব সরকার কথায় কথায় একদিন বলছিলেন, ‘ছোটবেলায় মেয়েটি দেখতে শ্রীকৃষ্ণের মতো ছিল! তাই ওর মা নাম দেয় কৃষ্ণা।’ বাবা স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে চিকিৎসক হবে মেয়ে। কিন্তু এখন আর সেই স্বপ্ন দেখেন না কৃষ্ণা। ফুটবল নিয়েই স্বপ্ন দেখেন দিনমান। অনুশীলন ক্যাম্প, ফুটবল ভবন, মাঠ, প্রস্তুতি ম্যাচ, আন্তর্জাতিক ম্যাচ—এসব নিয়েই সময় কেটে যাচ্ছে দিব্যি। বাবারও এখন আর কোনো আক্ষেপ নেই। বাবা চান, ফুটবল খেলেই দেশের সম্মান বয়ে আনুক কৃষ্ণা।
গত বছর সেপ্টেম্বরে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাইপর্ব পেরিয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠে বাংলাদেশ। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে হয়েছিল ওই ম্যাচগুলো। টানা পাঁচ ম্যাচ জিতে পুরো ১৫ পয়েন্ট নিয়ে চূড়ান্ত পর্বে ওঠে বাংলাদেশ। টুর্নামেন্টে এশিয়ার সেরা আট দলের একটি কৃষ্ণার দল। ঢাকায় হওয়া বাছাইপর্বের সর্বোচ্চ ৮টি গোল করেছিলেন এই কৃষ্ণাই! এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব এ বছর সেপ্টেম্বরে হবে থাইল্যান্ডে। এখন কৃষ্ণাদের যেন দম ফেলারও সময় নেই!
ভারতে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া এসএ গেমসে মেয়েদের ফুটবলে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ২-১ গোলে জেতে বাংলাদেশ। দুটি গোলই করেন কৃষ্ণা। এত সব সাফল্যের স্বীকৃতিও পাচ্ছেন, গত ফেব্রুয়ারিতে রূপচাঁদা-প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কারের ২০১৬ সালের বর্ষসেরা নারী ক্রীড়াবিদ হয়েছেন টাঙ্গাইলের মেয়ে কৃষ্ণা।
কৃষ্ণার খেলাধুলায় জড়িয়ে পড়া, এই পর্যায়ে উঠে আসা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। নারী বলেই প্রতিটি পদক্ষেপে লড়াই করতে হয়েছে। কৃষ্ণার জন্মের সময় ওর মায়ের অনেক কষ্ট হয়েছিল। তিন দিন ধরে ‘যমে-মানুষে’ টানাটানি। কৃষ্ণা বাঁচবেন কি না, তা নিয়েই সংশয়ে ছিলেন সবাই। তবে মেয়ে বলে বাবা কখনোই অবহেলা করেননি।
টাঙ্গাইলের গোপালপুর উপজেলার উত্তর পাথালিয়া গ্রামে কৃষ্ণাদের বাড়ি। অন্যদের মতো কৃষ্ণাও ছোটবেলায় খেলাপাগল ছিলেন। সারাক্ষণ কাকাতো ভাইদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে থাকতেন বলে মা প্রায়ই বকা দিতেন। একবার তো কৃষ্ণার হাত থেকে বল কেড়ে নিয়ে বঁটি দিয়ে কুচি কুচি করে কেটেই ফেলেছিলেন! তা দেখে কৃষ্ণার কাকা পরে একটা ফুটবল কিনে দেন। এখন অবশ্য কৃষ্ণার মা আর মোটেও রাগ করেন না।
কৃষ্ণার ফুটবলার হওয়ার পেছনে বড় অবদান কাকার। সকালে ঘুম থেকে তুলে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দূরে অনুশীলনে নিয়ে যেতেন। বাবার কাছে টাকা থাকত না। আসা-যাওয়ার ভাড়াটাও ওই কাকা দিতেন। এরপর উপজেলা পরিষদ থেকে সাইকেল দেওয়ার পর অনুশীলনে যেতে আর তত সমস্যা হয়নি।
কৃষ্ণার বাবার একসময় দরজির দোকান ছিল। টাকার অভাবে অনেক আগেই দোকানটা বন্ধ করে দিয়েছেন বাসুদেব সরকার। এখন অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করছেন তিনি।
ফুটবলে কৃষ্ণার হাতেখড়ি ২০১১ সালের বঙ্গমাতা স্কুল ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে। গোপালপুরের সুতি ভিএম পাইলট মডেল হাইস্কুলের হয়ে খেলেছিলেন। সেখানে কোচ গোলাম রায়হান অনেক সাহায্য করেন তাঁকে। এরপর ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কায় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৪ আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছেন। সেবার বাংলাদেশ দল খারাপ খেললেও কৃষ্ণা ছিলেন উজ্জ্বল ও ব্যতিক্রম। ২০১৫ সালে নেপালে একই প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন দলে খেলেন। কিন্তু পরের বছর তাজিকিস্তানে হওয়া এই প্রতিযোগিতায় বয়সের কারণে সুযোগ পাননি। এর আগে পাকিস্তানে ২০১৪ মহিলা সাফ গেমসে জাতীয় দলের হয়ে খেলেন। অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেন আফগানিস্তানের বিপক্ষে। ভারতে গত দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে মালদ্বীপের সঙ্গে যখন কেউ গোল পাচ্ছিলেন না, তখন দুটি দর্শনীয় গোল করেন কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা এখন বদলে গেছেন অনেক। মফস্বল থেকে উঠে আসা মেয়েটিই এখন স্বপ্ন দেখেন অনেক দূরে যাওয়ার, ‘আমাদের এখন আর আগের মতো ততটা আর্থিক অনিশ্চয়তা নেই। পড়াশোনার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। এখন আমি নিশ্চিন্তে ফুটবল খেলি। নিজেকে নিয়ে তাই অনেক বড় স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি বিশ্বমানের একজন ফুটবলার হব। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আমাদের নাম ছড়িয়ে পড়বে বিদেশে।’
পুরুষ ফুটবলের বিবর্ণ সময়ে মেয়েদের ফুটবল দিয়েই যেন বিশ্বকে নাড়া দিতে চান কৃষ্ণা। নিজে হয়ে উঠতে চান উজ্জ্বল বাতিঘর—‘আমি স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশ একদিন বিশ্বকাপে খেলবে।’ কথাটা মোটেও মিথ্যা বলেননি কৃষ্ণা। থাইল্যান্ডে এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্বে যদি সেরা তিনটি দলের মধ্যে থাকতে পারে বাংলাদেশ, তাহলে অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়ে যাবে কৃষ্ণারা।
শুধু তা-ই নয়, ফিফা র্যা ঙ্কিংয়ে কৃষ্ণারাই দেশের ফুটবলের ঝান্ডাটা উঁচুতে তুলে ধরার অভিযানে নেমেছেন। সেই পথে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে মেয়েরা, সামনে থেকে যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কৃষ্ণা।
লেখক: ক্রীড়া সাংবাদিক