কুকুর-বিড়ালের প্রতি এমিলের ভালোবাসা
নির্মমভাবে আছাড় মেরে এক কুকুরছানাকে হত্যার অভিযোগে আদালতে চলছে বিচারকাজ। অভিযোগ প্রমাণিত হলো। অপরাধী যুবককে ২০০ টাকা অর্থদণ্ড দিলেন বিচারক। ২০১৭ সালে সাভারে করা প্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা আইনে করা একটি মামলার ঘটনা এটি। এমন এক মামলার কথা জেনে নিশ্চয়ই অবাক হয়েছেন। অর্থের হিসাবে দণ্ডটি হয়তো খুব বড় অঙ্কের নয়। তবে ছোট করে হলেও এমন অপরাধের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সূচনা হিসেবে তো মন্দ নয়!
প্রাণী অধিকার রক্ষায় বাদী হয়ে মামলাটি করেছিলেন পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠাতা রাকিবুল হক। পরিচিতজনেরা তাঁকে চেনেন এমিল নামে। এই মামলার পর প্রাণী অধিকার রক্ষায় আরও দুটি মামলা করেছেন তিনি। এর মধ্যে একটি মামলায় কুকুর হত্যার অভিযোগে ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল রাজধানীর রামপুরার একজন নৈশপ্রহরীর। অন্য মামলাটি এখনো বিচারাধীন।
বেশ কয়েক বছর ধরে প্রাণীদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন এমিল। অনানুষ্ঠানিকভাবে তখন একা কাজ শুরু করলেও ২০১৬ সালে সমমনা বন্ধুদের নিয়ে চালু করেন ‘প ফাউন্ডেশন’। অসুস্থ-আঘাতপ্রাপ্ত বেওয়ারিশ প্রাণী উদ্ধার, চিকিৎসা ও আশ্রয়দান করে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটি। রাজধানীর মোহম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় রয়েছে তাঁদের নিজস্ব উদ্ধার কেন্দ্র। যেখানে বর্তমানে ১৮টি কুকুর-বিড়াল রয়েছে। এই প্রাণীগুলোর কেউ রাস্তায় দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পড়েছিল। আবার কাউকে শারীরিকভাবে অসুস্থ অবস্থায় এই উদ্ধার কেন্দ্রে নিয়ে আসা হয়েছিল। এমিল জানালেন, সুস্থ হওয়ার পর এই প্রাণীদের দায়িত্ব নিতে কেউ আগ্রহী থাকলে তাঁদের দিয়ে দেওয়া হয়। সেটি সম্ভব না হলে ওই প্রাণীদের নিজ এলাকায় রেখে আসা হয়। তবে সম্পূর্ণ সুস্থ না হলে বা পঙ্গু হয়ে গেলে সেই প্রাণীদের উদ্ধার কেন্দ্রেই রেখে দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে এমিল ও তাঁর বন্ধুরা মিলে মিরপুরের মাজার রোড থেকে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বিড়াল উদ্ধার করেছিলেন। আঘাতের ক্ষত সেরে গেলেও চলাফেরায় এখনো অস্বাভাবিক বিড়ালটি। তাই সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি এখন বিড়ালটির জন্য আশ্রয়কেন্দ্র।
উদ্ধার কেন্দ্রগুলোতে প্রাণীদের দেখাশোনা করার জন্য রয়েছেন সার্বক্ষণিক দুজন কর্মী। প্রাণীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসার জন্য তাঁদের একটি গাড়িও রয়েছে। এমিল বলেন, ‘আমরা যখন গাড়ি নিয়ে কোনো এলাকায় প্রাণী উদ্ধারে যাই, তখন ওই এলাকার মানুষ একদিকে অবাক হয়, আবার অন্যদিকে অনুপ্রাণিতও হয়। আমাদের কর্মযজ্ঞে সাহায্য করতে তখন তাঁরা এগিয়ে আসেন। নিজের এলাকার পশুপাখিদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিতেও তাঁরা তখন তৎপর হয়ে ওঠেন।’
স্বেচ্ছাসেবী এই সংগঠনটির লালমাটিয়া ও মিরপুরে রয়েছে ‘প লাইফ কেয়ার’ নামে দুটি প্রাণী চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র। বেওয়ারিশ প্রাণীদের উদ্ধার করে এখানে তারা বিনা মূল্যে সেবা দেন। তবে বাড়ির পোষা প্রাণীর ক্ষেত্রে নির্ধারিত ফি দিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। এ ছাড়া রয়েছে টেলিমেডিসিন সেবা। এই সেবার মাধ্যমে নির্দিষ্ট নম্বরে যোগাযোগ করে চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়া যায়। চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র দুটিতে সার্বক্ষণিক দুজন পশু চিকিৎসক থাকেন। এ ছাড়া তিনজন চিকিৎসকের সহকারী থাকেন।
এত বিশাল কর্মযজ্ঞ। কিন্তু আর্থিক জোগান আসে কীভাবে? জানতে চাইলাম এমিলের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল দুটি থেকে তাঁদের যে অর্থ আয় হয়, তা দিয়েই পুরো সংগঠনটির কার্যক্রম ও কর্মীদের সম্মানী বাবদ খরচ চালানো হয়। এ ছাড়া আমাদের পরিচিত কিছু প্রাণীপ্রেমী আছেন, যাঁরা স্বেচ্ছায় আর্থিকভাবে সহায়তা করেন।’
এমিল পেশায় একজন স্থপতি। পেশাগত কাজের বাইরের পুরোটা সময়ই দেন প্রিয় প্রাণীদের জন্য। সমমনা বেশ কিছু তরুণ আছেন এমিলের সঙ্গে। এদের কেউ পেশায় চিকিৎসক, ব্যাংকার, প্রকৌশলী, আবার কেউ–বা শিক্ষার্থী। রাজধানীর বাইরে খুলনা ও যশোরে তাঁরা কমিটি গঠন করেছেন। এমিলের স্বপ্ন, সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়বে তাঁদের কার্যক্রম। দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই মিলবে প্রাণীদের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা। আর প্রাণীর প্রতি দয়ালু হয়ে উঠবে সব মানুষ।