কারুপণ্যের আট নিপুণ শিল্পী
>কাল পয়লা বৈশাখ। বাংলা নববর্ষের উৎসবের রং ছড়িয়ে পড়বে সবখানে। বাঙালিয়ানা দেখা যাবে পোশাক, খাবার আর বিভিন্ন অনুষঙ্গে। টেপাপুতুল, নকশা করা শঙ্খ, সোলার মালা, খেলনা, কাঁসা–পিতলের গয়না, শীতলপাটি, নকশাদার হাতপাখা, বাঁশ–বেতের পণ্য—নববর্ষের অনুষঙ্গ। বছরের পর বছর ধরে কারুশিল্পীদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হচ্ছে এসব কারুপণ্য। ধারণ করছে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। একেক মাধ্যমে দক্ষ এমন আটজন খ্যাতিমান কারুশিল্পীর কথা থাকছে এই প্রতিবেদনে।
আফজাল ফকিরের খেলনা
আনোয়ার পারভেজ, বগুড়া
আফজাল ফকিরের বয়স তখন ১৮ বছর। চালচুলোহীন মানুষ। এর মধ্যেই পরিবার থেকে বিয়ে করানো হলো। কাজের সন্ধানে দিশেহারা আফজাল। কর্মহীন গ্রামে শেষমেশ বাবা সুলতান ফকিরের খেলনা তৈরির পেশাকেই বেছে নিলেন। বাবা-ছেলের হাতেই পোড়ামাটির খুরি, চাকতি, মোটা কাগজ, মাটির খুদে চাকা আর বাঁশের কাঠি হয়ে ওঠে টমটম, টরটরি—নানা খেলনা।
আফজাল ফকিরের বাড়ি বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার খোলাশ গ্রামে। বয়স এখন ৭৫ বছর। ১৯৬২ সাল থেকে খেলনা তৈরি করে চলেছেন তিনি। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বৈশাখী মেলায় ছুটে যান খেলনা নিয়ে। আফজাল ফকিরের কাছেই জানা গেল, তাঁর বাবা সুলতান ফকির, কুরানু মোল্লা আর আবুল হোসেনের হাত ধরে খোলাশ গ্রামে শুরু হয়েছিল খেলনা তৈরির কর্মযজ্ঞ। এখন তো গ্রামের কয়েক শ পরিবারের জীবিকা চলে খেলনা বানিয়েই।
খোলাশ গ্রামের মানুষ খেলনা বছরজুড়েই বানান। তবে বৈশাখের আগে আগে বেড়ে যায় ব্যস্ততা। আফজাল ফকিরও তাই মহা ব্যস্ত খেলনা তৈরিতে। ৩ এপ্রিল বাড়ির উঠানেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে তৈরি করছিলেন খেলনা। এরই মধ্যে আফজাল ফকির কথা বলে যান, ‘এই যে মাটির খুরি আর চাকাগুলো দেখছেন, এগুলো আসে পাশের টেঙ্গা পালপাড়া থেকে। সব খেলনাতেই কাঠের হাতল লাগে, আমরা করাতকল থেকে এসব হাতল সংগ্রহ করে নিজেরাই রং লাগাই।’ এরপর মাটির খুরি, চাকতি, চাকা ও মোটা কাগজ, বাঁশের কাঠি, সুতলি দিয়ে তৈরি হয় টমটম গাড়ি ও টরটরি গাড়ি। অন্যদিকে প্লাস্টিকের খেলনা তৈরিতে টিনের পাতি, প্লাস্টিকের চাকা, পাখি ও ফুলের আদলে কাঠামোর সঙ্গে হাতল লাগানো হয়।
আফজাল ফকিরের পরিবারের মতো গোটা খোলাশ গ্রামের শত পরিবারের ভাগ্য বদলেছে এই দুই চাকার খেলনা টমটমে। এখানকার খেলনা যাচ্ছে সারা দেশে। আফজাল ফকির যেন খোলাশের খেলনা গ্রাম হয়ে ওঠার এক নীরব সাক্ষী।
মনোয়ারার রঙিন পাখা
মোহাম্মদ মোরশেদ হোসেন, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম
৮ এপ্রিল যখন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়া নগরপাড়ায় মনোয়ারা বেগমের বাড়িতে পৌঁছালাম, তখন বৃষ্টি থেমে রোদ উঠেছে। উঠোনে কয়েকজন নারী বসেছেন হাতপাখা তৈরি করতে। কাপড়ে আর সুতার নকশায় সেগুলো হয়ে উঠছে রঙিন। নকশাখচিত একেকটা চিত্রকল্প যেন। কেউ পাখায় তুলছেন ফুলের নকশা, কেউ বাঁধাচ্ছেন পাখাটা। আর নকশা কেমন হবে, পাখা ঠিকমতো তৈরি হলো কি না—সবকিছু তদারক করছেন মোসাম্মৎ মনোয়ারা বেগম।
চন্দনাইশ উপজেলাটি হাতপাখার জন্য বিখ্যাত। এখানকার তৈরি বাহারি হাতপাখা ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। বৈশাখ তো বটেই সারা বছরই এই কারুপণ্যের কদর রয়েছে সমঝদারদের মধ্যে। মনোয়ারা বেগম একজন কারুশিল্পী। তাঁর হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় কাপড় ও সুতার রঙিন হাতপাখা। নিজে একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষ। শুধুই যে পাখা বানান, তা নয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে দুস্থ নারীদের প্রশিক্ষণও দেন তিনি।
মনোয়ারার স্বামী মো. আবুল কালাম ছিলেন হাতপাখার কারিগর। তিনিও পেয়েছিলেন জাতীয় পর্যায়ের স্বীকৃতি। ২৮ বছরের সংসারজীবনে স্বামীর কাছ থেকে মনোয়ারা রপ্ত করেছেন কীভাবে চোখের পলকে সাদা কাপড়ে রঙিন নকশা তোলা যায়।
২০১৭ সালের নভেম্বরে স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুতে যেন পাহাড়ই ভেঙে পড়েছিল মনোয়ারার ওপর। দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে পড়লেন অকূলপাথারে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি। ‘হাতে তুলে নালাম সুই-সুতা, চুমকি আর লালসালু। নকশা আঁকা শুরু করলাম সাদা কাপড়ে। নানা রকমের আলপনা এঁকে পাখা বানাতে লাগলাম।’ বললেন মনোয়ারা। এ যেন ছিল মনোয়ারার স্বপ্নবুনন। তাঁর তৈরি পাখার সুনাম ছড়িয়ে পড়তে থাকল।
স্বামীর দেখানো পথেই হাঁটলেন মনোয়ারা। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন। ২০১৬ সালে মাসব্যাপী লোকজ উৎসবে সেরা হাতপাখা শিল্পীর পুরস্কার পান তিনি।
মনোয়ারার উঠোনে সেদিন ২০–২৫ রকমের পাখা তৈরি হচ্ছিল। তিনি কাপড়ে সুতার নকশা করে দেন আর নারী কর্মীরা সেই নকশা ধরে পাখা বানিয়ে দেন। মনোয়ারা বলেন, ‘সারা বছর ধরে এ কাজ চলে। তবে চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত কাজ বেশি হয়। চট্টগ্রামের কেরানীহাট, বক্সিরহাট, ফটিকছড়ি, রাহাত্তারপুলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতার কাছে হাতপাখা বিক্রি করি।’
নিমাই মালাকার গাঁথেন সোলার মালা
কাজী আশিক রহমান, মাগুরা
মাগুরা শহর থেকে ২৬ কিলোমিটারের পথ। পিচঢালা, ইট বিছানো তারপর খানিকটা মাটির রাস্তা পেরিয়ে শালিখা উপজেলার শতপাড়া গ্রাম। এই গ্রামেই মালাকারদের বাড়ি। তাই পথ চলতে চলতে সারি সারি রঙিন মালা দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না, এটাই মালাকারদের বাড়ি। বাড়ির প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই দেখি, ঘরের বারান্দায় পাটি বিছিয়ে মনোযোগ দিয়ে সোলা কাটছেন এক ব্যক্তি। পরিচয়ে জানলেন, তাঁর নামই নিমাই মালাকার। কারুপণ্যের শিল্পী হিসেবে এই সোলাশিল্পীর পরিচিতি রয়েছে দেশজুড়ে।
৪২ বছরের নিমাই মালাকার পূর্বপুরুষের মালা তৈরির পেশাটাকেই আপন করে নিয়েছেন। নিমাইয়ের বাবা, দুই ভাইসহ শতপাড়া গ্রামে মোট আট ঘর এখন এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে নিমাই মালাকারের তৈরি পণ্যের কদর আলাদা। তাই তো ক্রেতার চাহিদা আসে সারা দেশ থেকেই। তবে বেশির ভাগ পণ্য সরবরাহ করেন ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে। রাজধানীর শাহবাগের বিভিন্ন সোলা তৈরির পণ্য বিক্রির দোকানে তাঁর তৈরি মালা স্থান পায়। জাপান ও আমেরিকাতেও দুই দফা পণ্য পাঠিয়েছেন নিমাই মালাকার।
অভিজ্ঞ মালাশিল্পী নিমাই মালাকার জানালেন, বৈশাখ উপলক্ষে মালার চাহিদা বেশি থাকে। তাই এখন শুধু মালাই তৈরি করছি। এ ছাড়া হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মনসাপূজা, লক্ষ্মীপূজা, বাস্তুপূজাসহ বিভিন্ন মেলায় চাহিদা থাকে তাদের সোলার তৈরি জিনিসের। উৎসবভেদে পণ্যের ধরনের পার্থক্য থাকে। কখনো বেলি ফুল, কখনো কদম ফুল বা চেরি ফুল। এর সঙ্গে হাতপাখা, পাখিসহ বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা থাকে।
স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে নিমাই মালাকারের সংসার। রান্নাঘরের কাজ শেষে স্বামীর কাজে সাহায্য করেন স্ত্রী কল্পনা মালাকার। নিমাই মালাকারের অবশ্য একটাই কাজ। সকালেই বসে পড়েন মালা তৈরিতে। নিমাই মালাকার জানালেন, ‘সকালে সোলা কিছুটা নরম থাকে বলে মালা তৈরিতে সুবিধা হয়।’ এরপর দিনভর পরদিনের মালা তৈরির জন্য সোলা প্রক্রিয়া করেন। সেই কাজেরই অংশী হলেন কল্পনা মালাকার।
নিমাই মালাকার বলছিলেন ভবিষ্যতের কথা। কিছুদিন আগেও চীনা প্লাস্টিক পণ্যের দাপটে ব্যবসায় ভাটা পড়েছিল। সেই সংকট কাটিয়ে উঠলেও সরকারের সহযোগিতা না পেলে শিল্পটা সম্প্রসারণ সম্ভব নয়। নিমাই মালাকারসহ সোলা কারিগরেরা তাই সেই সহযোগিতাপ্রত্যাশী।
গীতেশ দাসের বুননে শীতলপাটি
আকমল হোসেন, মৌলভীবাজার
গ্রামের একদিকে কাউয়াদীঘি হাওরের খোলা প্রান্তর, অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীতে বয়ে যাওয়া স্রোতময় জলরাশি। এমন এক নৈসর্গিক পরিবেশেই বাস গীতেশ চন্দ্র দাসের। ৬৮ বছর বয়সের সাদামাটা এক মানুষ। প্রায় ৫০ বছর ধরে বুনে চলছেন শীতলপাটি। এই শীতলপাটি বোনার কলাকৌশল প্রচলিত কোনো বিদ্যাপীঠ থেকে তাঁর অর্জিত নয়। একদম রক্তের কাছ থেকে পাওয়া ঐতিহ্য, উত্তরাধিকার।
৮ এপ্রিল সকালে এক দফা হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তাতে যেন আরও সবুজ হয়ে উঠেছে মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের তোলাপুর গ্রাম। এই গ্রামেরই একটি বাড়িতে থাকেন গীতেশ চন্দ্র দাস, শীতলপাটির কারুশিল্পী। বললেন, ‘৫০–৫৫ বছর ধরে শীতলপাটি বোনার কাজ করছি। বাবা বুনতেন। তাঁর কাজ দেখে দেখে শিখেছি। এটা আমাদের বংশপরম্পরায় চলে আসছে।’ তবে তিনি যেমন বাবার কাছ থেকে দেখে দেখে শিখেছেন, তাঁর সন্তানেরা কিন্তু শেখেননি। এক ছেলে ও দুই মেয়ে—পড়াশোনা করে আর ওপথে নেই।
শীতলপাটি এখন শৌখিন পণ্য। যে কারণে বাজারে তেমন চাহিদা নেই। একটি শীতলপাটি বুনতে যে খরচ ও শ্রম, তা বিক্রি করে লাভ দিয়ে সংসার সচল রাখা কঠিন। তবে সৃষ্টির যে ঘোরের জগৎ, একবার যাঁর রক্তে দোলা দিয়েছে, তাঁর তো সেই পথ থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। গীতেশ চন্দ্র দাস তাই চাইলেও চিকন মুর্তা বেত দিয়ে রঙিন নকশায় পাটি বোনার আনন্দ থেকে নিজেকে সরাতে পারেন না। হাল ছাড়তেও চান না তিনি। এক ভাইয়ের তৃতীয় শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেকে এখন শীতলপাটি বোনার কাজ শেখাচ্ছেন।
ভালো মানের নকশা করা একটি শীতলপাটি বানাতে একজনের প্রায় এক মাস সময় লাগে। মুর্তা বেত ও রঙে পাঁচ থেকে ৬০০ টাকা খরচ পড়ে। এ রকম একটি শীতলপাটি পাঁচ-ছয় হাজার টাকায় বিক্রি না করতে পারলে পোষানো যায় না। সাধারণ একটি শীতলপাটি বানাতেও সময় লাগে ১০ দিন। সেটাই দুই-আড়াই হাজার টাকা বিক্রি করতে হয়।
গীতেশ জানালেন, একসময় এলাকার তোলাপুর, বিলবাড়ি, সাদাপুর ও বেড়কুড়ি গ্রামে ঘরে ঘরে শীতলপাটি বোনা হতো। এখন আর নেই। তোলাপুরে সবেধন নীলমণির মতো তিনিই এখনো পড়ে আছেন শীতলপাটির সঙ্গে। এখনো বুনছেন শীতলপাটি, দস্তরখানা ও টেবিল ম্যাট।
শীতলপাটির কারুকাজের জন্য গীতেশ পেয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন স্মৃতি পুরস্কার ও কারুশিল্প পুরস্কার। কারুশিল্পী হিসেবে সরকারের প্রতিনিধি হয়ে ঘুরে এসেছেন চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া। সারা বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় শীতলপাটিকে অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেসকো। তাতে শীতলপাটিশিল্পীদের সুনাম বেড়েছে। সুদিন আসেনি।
শঙ্খে আঁকেন অনুপ নাগ
জিনাত শারমিন
অনুপ নাগের হাতের কাজের কোনো তুলনা নেই যেন। একটি ভিউকার্ডে দেবদেবীর ছবি দেখে শঙ্খের ওপর তা কী নিখুঁতভাবেই না এঁকেছেন, এঁকেছেন রাধাকৃষ্ণ, ময়ূর, সাপ। বাদ যায়নি জয়নুল আবেদিন বা এস এম সুলতানের ছবিও। ১২ বছর ধরে শঙ্খ দিয়ে বানিয়েছেন অপরূপ কারুকার্যময় বরের মাথার টোপর। সেটি এখন শোভা পাচ্ছে নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরে। আগ্রহ নিয়ে দেখাচ্ছিলেন তাঁর বানানো সব শিল্পকর্ম।
তিনি অনুপ নাগ। এই নাম একজন সংগ্রামী শিল্পীর নাম, একটা শিল্পের ধারকের নাম। ৩০ বছর ধরে তিনি বেলা ১১টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শঙ্খের ওপর আঁকছেন। রাত হলে নির্জনে দুটো মোমের আলোয় কাজ করেন। বললেন, ‘এটাই তাঁর কাজের ঘর, এটাই তাঁর মন্দির।’ এই মন্দিরেই শঙ্খ দিয়ে গড়ছেন নানা কিছু। কখনো শঙ্খ গায়ে পিঠে নানা নকশা নিয়ে বহুগুণে সুন্দর হয়ে শোভা বর্ধন করছে শোকেসে। আবার কখনোবা এই সব শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় প্রতিনিয়ত রূপ বদলাচ্ছে শঙ্খরা। হয়ে যাচ্ছে শাঁখা, গলার মালা, চাবির রিং, চুলের কাঁটা থেকে শুরু করে মোমদানি—সবই।
অনুপ নাগের একেকটা শঙ্খ আঁকতে সময় লাগে দেড় মাস থেকে তিন মাস। আর তা বিক্রি হয় ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায়। শাখা বিক্রি হয় ৫০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিসও আছে বিভিন্ন দামের।
এ তো গেল বর্তমানের কথা। চশমা খুলে হাতে নিয়ে অনুপ নাগ ফিরে গেলেন পেছনে। ইংরেজ আমলে নাকি শাঁখারীবাজারে শঙ্খশিল্পীর সংখ্যা ছিল হাজারের বেশি। এরপর ১৯৪৭ সালে প্রায় সবাই চলে গেলেন কলকাতা। তারপরও পাকিস্তান আমলে ছিল প্রায় তিন থেকে চার শ ঘর। এখন এই শাঁখারীবাজারে শঙ্খশিল্পী আছেন হাতে গোনা সাত বা আটজন। সাতপুরুষের শঙ্খশিল্পী অনুপ একসময় কাজ করতেন স্বর্ণের দোকানে, তারপর আঁকতেন সিনেমার পোস্টার, ব্যানার। আর সঙ্গে টুকটাক করতেন শঙ্খ আঁকার কাজ। এমন সময় একদিন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করার সময় একদিন শাঁখারীবাজার ঘুরে দেখতে এসে অনুপ নাগের কাজ থেকে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁকে ভারতের যোধপুরে (শঙ্খের কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত) পাঠালেন। সেখান থেকে ফিরে এসে কী যেন হলো। অনুপ নাগ পুরোদমে শঙ্খ আঁকা শুরু করলেন। সেই যে শুরু, এই ৫৯ বছর বয়সে এসেও থামেননি, দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, থামবেন না।
শাহ আলমের বাঁশপণ্য
কামনাশীষ শেখর, টাঙ্গাইল
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে বর্ণী গ্রাম। গ্রামের শতাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় বাঁশ ও বেতের সামগ্রী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারা সাধারণত কুলা, ধামা, পলো, ঝাড়—এ ধরনের গৃহস্থালি পণ্য তৈরি করতেন। সময়ের আবর্তে এসব পণ্যের চাহিদা কমে যায়। ফলে অনেকেই অন্য পেশা বেছে নেন।
এ গ্রামেরই সন্তান শাহ আলম। ছোটবেলাতেই বাঁশ–বেতের কিছু কাজ শিখেছিলেন। ১৯৮৯ সালে এইচএসসি পাস করার পর বাঁশ–বেতের সামগ্রী তৈরির কাজ শুরু করেন। শাহ আলম বলেন, ‘ওই সময় কাজ করতে গিয়ে দেখি, দিন দিন প্রচলিত সামগ্রীর চাহিদা কমছে। চিন্তা করি, নতুন নতুন সামগ্রী তৈরি করতে হবে। তবেই এ পেশায় টিকে থাকা যাবে।’
এই ভাবনা থেকেই ১৯৯৩ সালে ঢাকার একটি অভিজাত কারুপণ্যের দোকানে গিয়ে কথা বলেন শাহ আলম। সেখানে তাঁকে বাঁশের তৈরি ট্রে ও বেতের তৈরি টেবিল ম্যাট নকশা দিয়ে সেগুলো তৈরি করে দিতে বলা হয়। শাহ আলম সেগুলো তৈরি করে সরবরাহ করার পর তাদের পছন্দ হয়। তারপর থেকে নিয়মিত সরবরাহ শুরু হয় ঢাকার বিভিন্ন কারুপণ্যের দোকানে।
এখন শুধু ঢাকা নয়, দেশের গণ্ডি ছাপিয়ে জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত যাচ্ছে শাহ আলমের তৈরি বাঁশশিল্প। শাহ আলম এখন পেপার ঝুড়ি, লন্ড্রি ঝুড়ি, টেবিল ল্যাম্প, ফ্লোর ল্যাম্প, গয়নার বাক্স, ফটোস্ট্যান্ড, বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন জিনিসপত্র তৈরি করছেন।
৯ এপ্রিল শাহ আলমের বাড়ি গিয়েও দেখা মিলল সেই চিত্র। পাঁচ–ছয়জন কর্মী কাজ করছেন তাঁর উঠানে। তাঁদের সঙ্গে শাহ আলম নিজেও হাত লাগিয়েছেন। এক ফাঁকে জানালেন, শুধু নিজ বাড়িতে নয়, তিনি গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে কাঁচামাল দিয়ে আসেন। ওই সব বাড়ির লোকেরা তাঁর চাহিদামতো বাঁশের পণ্য তৈরি করে দেন।
নিজ গ্রামে হারিয়ে যেতে বসা বাঁশশিল্পকে আলোর মুখ দেখিয়ে শাহ আলম স্বীকৃতিও পেয়েছেন।
২০০২ সালে বাংলাদেশ কারুশিল্প পরিষদের ‘শিলু আবেদ কারুশিল্প পুরস্কার’ লাভ করেন। ২০১৬ সালে পেয়েছেন লোকশিল্প জাদুঘর প্রদত্ত পুরস্কার। কারুশিল্পবিষয়ক বিভিন্ন প্রদর্শনী ও কর্মশালায় অংশ নিতে ভ্রমণ করেছেন জাপান, মালয়েশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে।
শাহ আলম বলছিলেন, প্রতিদিন বাঁশের তৈরি সামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে। তাই অনেক মানুষ সম্পৃক্ত হচ্ছে এ কাজে। যাঁরা কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁরাও আবার ফিরে আসছেন এ কাজে।
দিলীপ কারিগরের গয়না
আব্দুল মোমিন, মানিকগঞ্জ
দিলীপ সরকারের পেশাটা বংশপরম্পরা থেকে পাওয়া। সেটা কাঁসা-পিতলের তৈজস তৈরির কাজ। প্রয়াত বাবা রবীন্দ্রনাথ সরকার হাতেখড়ি দিয়েছিলেন। তবে পারিবারিক সেই পেশায় স্বপ্ন দেখতে পাননি ১৮–১৯ বছরের দিলীপ। তাহলে তিনি কী করবেন? পেশা ছেড়ে দেবেন?
ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে গেল কয়েক বছর। তাঁদের কাজের কদর আরও কমে গেল। দিলীপ সরকার পেশা বদল করলেন না, বদলালেন মাধ্যম। নিজেদের কাঁসা-পিতলের তৈজস তৈরি বাদ দিয়ে জড়িয়ে পড়লেন সোনা ও রুপার অলংকার তৈরিতে। ঢাকার নিউমার্কেটের একটি দোকানে প্রায় সাত বছর এই কাজ করলেন। কিন্তু মন ভরছিল না দিলীপ সরকারের।
দিলীপ সরকারের বয়স এখন ৬৫ বছর। তাঁর নকশা করা কাঁসা-পিতলের বাহারি গয়না এখন রাজধানীর ফ্যাশন হাউসগুলোতে পাওয়া যায়। কিন্তু কাঁসা-পিতলের তৈজসপত্র ফেলে অলংকার তৈরির কাজ কীভাবে শুরু করলেন? দিলীপ সরকার ফিরে যান অতীতে। বলেন, ‘ঢাকা নিউমার্কেটে সোনা-রুপার গয়না তৈরির সময় একদিন এক কারুশিল্পীর সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনিই পরামর্শ দিয়েছিলেন।’
পরামর্শটা ছিল কাঁসা-পিতলের গয়না তৈরির। আজন্ম তৈজসপত্র বানানো কাঁসা-পিতলে তৈরি করব গয়না? চলবে তো? কিন্তু চ্যালেঞ্জটা নিলেন দিলীপ। সে ২০ বছর আগে। সোনা-রুপা ছাড়াও যে ভিন্ন ধাতুর গয়নার কদর আছে, তা তিনি কাজ শুরু করে বুঝলেন।
ঢাকার ধামরাইয়ের কায়েতপাড়া গ্রামের সমাপ্তি শিল্পালয়ের পরিচালক দিলীপ সরকার চলে এসেছেন মানিকগঞ্জ শহরের স্বর্ণকারপট্টিতে। স্বর্ণকারপট্টির তিনতলা ভবনের নিচ তলায় কাজের ফাঁকে কথা এগোয় তাঁর সঙ্গে। দিলীপ সরকার জানান, কাঁসা-পিতল দিয়ে কানের দুল, হাতের চুড়ি ও বালা, গলার মালা, পায়ের নূপুর, চুলের ও খোঁপার কাঁটাসহ নানা গয়না তৈরি করেন। তারপর তা বিক্রি করেন ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন স্থানের গয়নার দোকান ও ফ্যাশন হাউসে।
কাঁসা-পিতলের গয়না তৈরিতে দিলীপ সরকারের সুখ্যাতি এ পেশার মানুষের অজানা নয়। ২০১৩ সালে হস্তশিল্প নিয়ে সার্কের ছয় দিনের মেলায় কাঁসা-পিতলের তৈরি গয়নার স্টল দেন। পরের বছর বাংলা একাডেমি এবং বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প করপোরেশন (বিসিক) আয়োজিত মেলাতেও তিনি স্টল বরাদ্দ পান।
সম্মান ও সুখ্যাতি পেলেও মনের মধ্যে কষ্ট রয়েছে দিলীপের। বললেন, ‘এসব কাজের প্রচুর চাহিদা থাকলেও অনেকেই এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন আয় কম হওয়ার কারণে। তবে এই শিল্প বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে।’
দিলীপ সরকারের মতো কারিগরদের সুদিন আসুক, এই তো প্রত্যাশা।
সুবোধ পালের টেপাপুতুলের ইতিকথা
আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী
রাস্তার পাশে শখানেক টেপাপুতুল রোদ পোহাচ্ছে। পুতুলের পাশে প্রায় ৪০ বছর বয়সী একজন বসে রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি এই পুতুলগুলোর মালিক। নিজের সন্তানের মতো পুতুলগুলোকে আগলে বসে রয়েছেন।
আসলে তিনি কাঁচা মাটির পুতুলগুলোকে রোদে শুকোতে দিয়ে পাহারায় রয়েছেন, যাতে কেউ নষ্ট না করে। তাঁর কাছে গিয়ে সুবোধ পালের বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে তিনি হেসে বললেন, ‘আমিই সুবোধ পাল।’
পরে বোঝা গেল রাজশাহীর পবা উপজেলার বসন্তপুর গ্রামে গিয়ে সুবোধ পালের বাড়ির ঠিকানা কাউকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। টেপাপুতুলই সুবোধ পালের পরিচয় নিয়ে রাস্তার পাশে বসে থাকে। কারণ প্রতিদিন এভাবে রাস্তার পাশে সুবোধ পালের টেপাপুতুল শুকাতে দেওয়া হয়। ৯ এপ্রিল এই দৃশ্যই দেখা যায়।
সুবোধ পাল ৫০ রকমের টেপাপুতুল তৈরি করেন। তার মধ্যে রয়েছে হাতি, ঘোড়া, ময়ূর, কচ্ছপ, টিকটিকি, পাখি, সাপ, মহিষের মুখ, হরিণের মুখ, পাতিহাঁস, রাজহাঁস, মুখোশ। মেলার সময় বেশি করে তৈরি করেন। দেশের বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করেন। এটাই তাঁর একমাত্র পেশা। পুতুলের পাশাপাশি পূজার মৌসুমে প্রতিমা তৈরির কাজও করেন। কেউ ফরমাশ দিলে তিনি টেরাকোটার কাজও করে দেন।
সুবোধ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে বাবা শিশির চন্দ্র পালের পেশাকেই নিজের পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বিয়ের পরে স্ত্রী বিজলী রানি পালকে এই পেশায় হাতেখড়ি দিয়েছেন তিনি। কন্যা বীথি রানি পাল একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। ছেলে সজীব কুমার পাল নবম শ্রেণির ছাত্র। তারা বাবার দেখাদেখি পুতুলের কারিগর হয়ে গেছে।
মেলার সময় সব কাজ ফেলে পরিবারের সব সদস্য পুতুল তৈরিতে ব্যস্ত থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও ঢাকায় বাংলা একাডেমির বৈশাখী মেলায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ঢাকার মেলায় সুবোধ পাল তাঁর তৈরি সবচেয়ে বড় পুতুলের দাম হাঁকেন এক থেকে দেড় হাজার টাকা। আর সবচেয়ে ছোট পুতুল বিক্রি করেন ২০ টাকায়। ছোট থেকেই সব মেলায় ছেলে সজীবকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। সজীব বাবার কাজে সহযোগিতা করে।
সুবোধ বললেন, কারুশিল্পী হিসেবে বিভিন্ন মেলায় ডাক পান। সম্প্রতি গাজীপুরে একটি মেলায় ডাক পড়েছিল। তিন দিনের মেলা করে এসেছেন। ছেলেও গিয়েছিল সঙ্গে। তিনি বলেন, নিজে বাবার পেশা গ্রহণ করলেও ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাচ্ছেন। যত দূর তারা পড়তে পারে, তিনি তাদের পড়াবেন। লেখাপড়া শেখার পর তারা তাদের পছন্দের পেশা বেছে নেবে, এটাই তাঁর মনে বাসনা।