কাপড়ের পুতুল
ছোটবেলায় আব্বুর ব্যাগটা ছিল কৌতূহলের বস্তু। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতেই দৌড়ে গিয়ে ব্যাগটা হাতে নিতাম। মিনিট দশেক রীতিমতো চিরুনি অভিযান চালানোর পর তবেই নিস্তার। আহামরি কিছু পাওয়া যেত না। কখনো ধাঁধার বই, খবরের কাগজ, লম্বা কলম, বাদামের প্যাকেট, কখনো থাকত দাদুর দেওয়া বিশেষ কিছু। দাদু দিতেন আমসত্ত্ব, পুতুল বানানোর কাপড়, ছোট হাঁড়ি-পাতিল।
স্কুল আর পড়াশোনার কারণে আমরা তখন যাত্রাবাড়ী থাকতাম। আব্বুর কলেজ ছিল নরসিংদী সদরে, দাদুবাড়ির কাছেই। এই সুযোগে দাদু প্রায়ই আমাদের জন্য কিছু না কিছু পাঠাতেন। যেদিন দাদু আমার পুতুলের জন্য বাক্স অথবা ছোট জামা বানানোর কাপড় পাঠাতেন, সেদিন আমার যেন ঈদের আনন্দ! চুপিচুপি পা টিপে টিপে আম্মুর ড্রয়ার থেকে ছোটদের জন্য ‘নিষিদ্ধ ঘোষিত’ কাঁচি নিয়ে বারান্দার দরজার পেছনে বসে কালো সুতায় কেশবতী পুতুল বানাতাম। পুতুল কন্যার সুন্দর নাম রাখতাম। তার জন্য ঘর সাজাতাম সুন্দর করে। দেশলাইয়ের বাক্স দিয়ে খাট আর ক্রিমের বাক্সে হতো কাপড় রাখার আলমারি। জামা বানিয়ে বেচে যাওয়া কাপড় লম্বা করে কেটে হতো আমার আদরের পুতুলের শাড়ি। রঙিন পুঁতি আর সুতো দিয়ে কী অসম্ভব গয়না বানাতাম!
কোথায় থেকে যেন একটা ছোট্ট আয়নাও জোগাড় করেছিলাম। বান্ধবী অহনাদের বাসায় নীল রঙের ওয়াশিং মেশিন দেখেছিলাম। খুব সুন্দর! আমার পুতুলের ঘরে এমন একটা সুন্দর জিনিসের অভাব থাকবে, তা মোটেও সম্ভব না। কাগজের বাক্সে নীল রঙের কাগজ লাগিয়ে বানিয়ে ফেললাম ‘ওয়াশিং মেশিন’! এখনো স্পষ্ট মনে আছে, নিয়ম করে প্রতিদিন পুতুলের শাড়ি বদলে দিতাম। রান্না হতো ফুল-পাতার তরকারি আর বালির পায়েস। ইটের টুকরো দিয়ে মাংস রাঁধতাম। মাঝেমধ্যে পাশের বাসার বান্ধবীর পুতুলের বাড়িতে আমার কন্যা পুতুল বেড়াতে যেত।
এখন কত রঙের কত ঢঙের পুতুলের সেট কিনতে পাওয়া যায় বাজারে। তবুও মনে হয়, আমাদের সেই কাপড়ের পুতুলের মতো আর কিছুই হয় না। কত আবেগ, কত সময়, কত আদর! আহা!
জুয়াইরিয়া জাহরা হক
মিরপুর, ঢাকা