করোনাকাল যাঁদের উদ্যোক্তা বানিয়েছে
করোনাকালে ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ। এই অবসর কাজে লাগিয়ে অনেক শিক্ষার্থীরই উদ্যোক্তা হিসেবে হাতেখড়ি হচ্ছে। কেউ সময়টাকে কাজে লাগাতে চেষ্টা করছেন, কেউবা আরও বড় স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন। করোনাকালে উদ্যোক্তা হয়েছেন, এমন কয়েকজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে লিখেছেন হাসান ওয়ালী
আতিকুরদের ‘রাখিব’
ছোটবেলা থেকেই জি এম আতিকুর রহমান বন্ধুদের মধ্যমণি। পড়াশোনা থেকে শুরু করে নানা কাজে এগিয়ে যান নিঃস্বার্থভাবে। রাজধানীর ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে স্বভাবটাই যেন দায়িত্বে পরিণত হলো। সিআর (ক্লাসের প্রতিনিধি) বলে কথা! করোনার ছুটি বাড়তে থাকায় আতিকুরের বন্ধুরা ঢাকার বাসা ছাড়তে লাগলেন একে একে। বন্ধু সাবরিনা স্বর্ণা ঢাকার বাসা ছেড়ে বগুড়ায় থাকবেন। বিপত্তি বাধল জিনিসপত্র নিয়ে। এমন ঘটনা ঘটল আরও কয়েকজন বন্ধুর ক্ষেত্রে।
এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিলেন আতিকুর। সবার পরামর্শে ছোট একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সব বন্ধুর খাট-তোশক রাখা শুরু করলেন। তখনই আতিকুরের মাথায় এল ব্যবসার ধারণা। ‘ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ভাবলাম, আমি তো ব্যবসা শুরু করতে পারি। তাতে অন্যদের উপকারও হলো। মোহাম্মদপুরের বছিলায় একটি পাঁচ রুমের ফ্ল্যাট নিয়ে বন্ধু সৈকত আহমেদ আর ছোট ভাই জি এম আশিকুর রহমানকে নিয়ে শুরু করলাম “রাখিব”।’ বলছিলেন আতিকুর।
শুরুটা হলো ফেসবুক পেজের মাধ্যমে। প্রচারের জন্য জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। তবে শিক্ষার্থী বলে কেউ নাকি খুব একটা পাত্তা দেয়নি বলে জানালেন। তবে ক্রমেই মানুষের আস্থা অর্জন করতে থাকে আতিকুরদের ‘রাখিব’। বর্তমানে ৫৫টি পরিবারের যাবতীয় সরঞ্জাম আছে আতিকুরদের হেফাজতে।
আতিকুরের ‘রাখিব’তে খাট রাখলে মাসে দিতে হয় ৩০০ টাকা। ফ্রিজে ৫০০ আর তোশকে ৭০। অন্যান্য জিনিসেও নির্ধারিত মূল্য রেখেছেন মাসিক হিসাবে। তবে আতিকুরের উদ্দেশ্য শুধু টাকা আয় করা নয়। করোনার প্রকোপে ঢাকা ছাড়ার আগে নিরাপদ জায়গায় শখের জিনিস রাখতে পারলে যে তৃপ্তি পায় মানুষ, তাতেই বেশি খুশি হন তাঁরা।
রান্নাঘরই মেফতার ‘অফিস’
‘ছোটবেলা থেকেই আমার চাকরি ভালো লাগে না। উদ্যোক্তা হওয়ার শখ। সে শখটাই আসলে করোনাকালে পূরণ হলো। আগে অনেক ভাবলেও সময়-সুযোগের অভাবে শুরু করা হয়নি। করোনার সময় বড় ভাইয়ের অনুপ্রেরণায় শুরু করি। সেদিক থেকে বলতে গেলে আমার জন্য সময়টা কাজে লাগছে।’ এভাবেই স্বপ্নের পথে হাঁটার গল্প বলছিলেন মেফতা বিনতে মাহবুব।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মেফতার ‘আমাদের রসুইঘর’ নাম করেছে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহে। তাঁর নিজের হাতে বানানো জার কেকের ক্রেতা বাড়ছে দিন দিন। প্রতিদিন ৮ থেকে ২০টা কেক বানান তিনি। বাসার রান্নাঘরই তাঁর ‘অফিস’। কেকের দামও মোটামুটি সস্তা। ১২০ টাকা থেকে ১৩৫ টাকা। সহকারীর মাধ্যমে এই কেক পৌঁছে দেন ক্রেতার হাতে। তাতেই দিন–রাত একাকার মেফতার।
করোনাকালে কেকের শেফ হিসেবে তাঁর সুনাম ছড়িয়েছে। তবে খারাপ অভিজ্ঞতাও কম নয়। প্রশংসার বিপরীতে নানা বাজে মন্তব্য পেয়েছেন। ‘অনেকেই নানা ধরনের বাজে মন্তব্য করে। মেয়ে পড়ালেখা শেষ না করে ব্যবসা শুরু করে দিয়েছে...ইত্যাদি। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই ইতিবাচক রিভিউ দিচ্ছেন। আমার মা-বোন সব সময় আমাকে সাহস দেন। সবার সাহস নিয়ে ব্যবসাটা আমি চালিয়ে যেতে চাই।’
‘প্যাড়া’ ভালোবাসেন আজমেরী
‘করোনায় বসে বসে বিরক্ত হচ্ছিলাম। একটু একটু করে ছুটি বাড়ছে। অন্যদিকে কোনো কাজ নাই। সব মিলিয়ে ভাবলাম, কিছু একটা যদি করা যায়। আমি তো জামালপুরের সরিষাবাড়ির মেয়ে, আমার বাসার পাশেই প্যাড়া সন্দেশ অনেক ভালো বানায়। বেশ জনপ্রিয় এখানে। ভাবলাম মিষ্টির ব্যবসাই শুরু করি,’ এই ছিল পরিকল্পনা। এখন পুরোদমে চলছে রাজধানীর স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী আজমেরী আক্তারের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান—‘আপন’।
আজমেরীর ‘আপন’–এ মূল চাহিদা প্যাড়া সন্দেশের। জুলাইয়ের শেষ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ১৪৫ কেজি প্যাড়া বিক্রি করেছেন তিনি। এ ছাড়া রস কদম আর কালো জামও চলছে বেশ। আজমেরী ব্যবসা শুরু করেছিলেন নিজের জমানো পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে। করোনাকালে এই ব্যবসা থেকে আয় এখন লাখ ছোঁয়ার অপেক্ষায়।
সারা দেশেই যাচ্ছে আজমেরীর প্যাড়া সন্দেশ। ফোরজি ইন্টারনেটের কল্যাণে দূরদূরান্ত থেকেও অর্ডার আসে। আজমেরী জানালেন, অর্ডারের সময় কুরিয়ার খরচ দিলেই তারা পাঠিয়ে দেন যেকোনো ঠিকানায়। আপন-এর জন্য মিষ্টি বানান জামালপুরের পাঁচজন কারিগর। তাঁরা অবশ্য অন্য কাজের ফাঁকেই এ কাজ করেন। তবে আজমেরী স্বপ্ন দেখছেন নিজস্ব কারখানা আর ঢাকায় একটি মিষ্টান্ন ভান্ডারের।
শরিফুলদের রুপালি স্বপ্ন
কুমিল্লার ছেলে শরিফুল ইসলাম পড়ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেন সারা দেশের বড় শহরগুলোতে ইলিশের সুপারশপ হবে। সারা দেশের মানুষকে ইলিশের আসল স্বাদ দিতেই শরিফুলের এই ভাবনা। তবে ইলিশ নিয়ে কিছু একটা শুরু করাটাই আর হয়ে ওঠে না। সে সুযোগ করে দিল করোনাকাল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটি পাওয়ার পর শরিফুল আর বসে থাকেননি। জমানো ৩৬ হাজার টাকা নিয়ে শুরু করেন ‘ইলিশ বাজার’। তখন অনলাইনে ইলিশ কেনাবেচার উদ্যোগ খুব বেশি ছিল না। শরিফুলের ইলিশ বাজার প্রথম কয়েক দিনের মধ্যেই পায় ৪০ কেজি মাছের অর্ডার। বাসে করে ঢাকাসহ কয়েক জেলায় পাঠান চাঁদপুরের ইলিশ। আস্তে আস্তে বাড়তে শুরু করেছে ‘ইলিশ বাজার’। শরিফুলের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন আরও দুজন। আর ৩৬ হাজার টাকা দাঁড়িয়েছে দুই লাখে।
ইলিশ বাজারের সফলতায় শরিফুলের স্বপ্ন এখন ডালপালা মেলেছে। শরিফুলের মুখেই শোনা যাক। ‘দেশের সব অঞ্চলের মানুষকে রুপালি ইলিশের স্বাদ দিতে আমরা সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর ও রাজশাহী শহরে তাজা রুপালি ইলিশের সুপারশপ করতে চাই। ধারাবাহিকভাবে অন্য শহরগুলোও আমাদের পরিকল্পনায় রয়েছে।’
রেদওয়ানের রেস্তোরাঁ
চতুর্থ বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার অপেক্ষায় ছিলেন রেদওয়ান ইসলাম। যশোরের মুসলিম এইড ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির কম্পিউটার বিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন পুরোদমে। পরীক্ষার ফল হাতে পাওয়া মানেই তো স্নাতক হয়ে যাওয়া, আর পুরোদস্তুর পেশাজীবনে পা রাখা। হঠাৎই করোনা সে স্বপ্নে আঘাত হানে প্রবলভাবে। করোনার ছুটিতে মাসখানেক পেরোতেই হতাশ হয়ে পড়েন রেদওয়ান। ভাবতে থাকেন, সময়টা কীভাবে কাজে লাগানো যায়।
নানা রকম মুখরোচক খাবারের প্রতি রেদওয়ানের আগ্রহ সেই ছোটবেলা থেকে। ভাবেন, খাবার নিয়েই কিছু একটা করা যায় কি না। যেই ভাবা সেই কাজ। গ্রাফিকস ডিজাইনের কাজ করে জমানো কিছু টাকা নিয়ে এক বন্ধুর দ্বারস্থ হন। পরিবারও ছেলের উদ্যোগে এগিয়ে আসে। শুরু হয় ‘ব্লু মুন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পিত্জা কর্নার’–এর যাত্রা।
রেদওয়ান বলছিলেন, ‘চাকরি বাকরির সুযোগ নাই। আর যে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, কবে পড়াশোনা শেষ করব আর কবে চাকরি করব, তার তো হিসাব নাই। ভাবলাম অন্তত কিছু একটা করি। তাতে কিছু টাকাও আয় হবে। পরিবারকে সহায়তা করাও হবে।’
ঝিনাইদহ পুলিশ লাইনসের সামনে শুরু হয় রেদওয়ানের রেস্তোরাঁ। তবে করোনাকালে বেশির ভাগ বিক্রিই চলছে অনলাইনে।ফোরজি ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইনে রেস্তোরাঁর প্রচারণা চালাচ্ছেন তিনি। পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, পাস্তাসহ নানা সেট মেনু দিয়ে ধীরে ধীরে পরিচিতি পাচ্ছে ব্লু মুন রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড পিৎজা কর্নার। রেদওয়ানের রেস্তোরাঁয় বর্তমানে কর্মী আছেন চারজন। ভাঙা স্বপ্ন জোড়া লাগতে শুরু করেছে, সে কথা এই শিক্ষার্থী হাসিমুখেই জানালেন।
স্বপ্ন দেখাচ্ছে কানিজের স্বপ্নতান
কানিজ ফাতেমা বরাবরই নিজে কিছু করতে চান। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে পড়ার পাশাপাশি নানা প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ করেছেন বিভিন্ন মেয়াদে। তবে নিজের স্বপ্নের কাজ শুরু করলেন করোনাকালে।
কানিজ ফাতেমার ‘স্বপ্নতান’ প্রতিনিয়ত ঐতিহ্যবাহী কাপড়ের নানা নকশায় সমৃদ্ধ হচ্ছে। নকশাগুলো তিনি নিজেই করেন। ছোটবেলা থেকে আঁকাআঁকির অভ্যাস ছিল। সেটাই কাজে লাগছে বলে আরও খুশি কানিজ। নিজের জমানো ২০ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করা স্বপ্নতান নিয়ে তাই স্বপ্নের সীমা নেই তাঁর।
কানিজ বলছিলেন, ‘এখন পর্যন্ত কুমিল্লার খাদি, বিছানার চাদর, বাটিকের সংগ্রহ, টাঙ্গাইলের তাঁতের কাপড় আমি গিয়ে কিনে এনেছি। এগুলোর ওপরে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে আমি আঁকাআঁকি করি। নিজের ডিজাইন দিয়ে আলাদা করার চেষ্টা করি। ক্রেতারাও অনেকে পছন্দ করছেন। সকালে পেজে বিছানার চাদর ছবি পোস্ট করছিলাম, চারটা বিক্রি হয়ে গেছে।’
শুরুর দিকে নিজের পরিচিতদের মধ্যে বিক্রি সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন ঢাকার বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্ডার আসে প্রায় প্রতিদিনই। কানিজ ফাতেমার এক সহকারী সাইকেল চালিয়ে দিয়ে আসেন ক্রেতার দোরগোড়ায়। কানিজ ফাতেমার লক্ষ্য শুনুন তাঁর মুখেই, ‘সারা দেশের ঐতিহ্যবাহী কাপড় সংগ্রহ করে আমি পছন্দের ডিজাইন করে মানুষের হাতে তুলে দিতে চাই।’