কম জায়গায় ভালো বাড়ি বানাবেন যেভাবে
একটি ছোট ঘর। ঘরের একটি কোনা রান্নাঘরের মতো বানিয়ে সেখানেই সেরে ফেলা হয় রান্না। ওপরের ছাদে একটুখানি ছিদ্র। সেটিই ঘরের একমাত্র জানালা। সেখান থেকে প্রায়ই আকাশ ঢুকে পড়ে ঘরে। সেই ঘরেই সাত বছর ধরে আটকে রাখা হয়েছে জয় নিউসামকে। সেই ঘরেই জন্ম নেয় জয়ের ছেলে জ্যাক। সেখানেই কেটে যায় সেই শিশুর প্রথম পাঁচ বছর। তাতে অবশ্য জ্যাকের বিশেষ অসুবিধা হয়নি। কেননা, সে জন্মেই দেখছে এই ঘর। বাইরের বিশ্ব দেখার আগপর্যন্ত সেই ঘরই তার বাড়ি, সমস্ত পৃথিবী। ঘর আর বাকি বিশ্বের সঙ্গে মা–ছেলের যোগাযোগ হয় ছাদের ওই ছোট্ট ফাঁক দিয়ে। রুম (২০১৫) নামের এই সিনেমায় জ্যাকের মা ‘জয়’–এর ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করে ক্যারিয়ারের একমাত্র অস্কারটি জিতে নেন ব্রি লারসন। সিনেমাটি যদি আপনি দেখে থাকেন, তাহলে এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন, কেন আর কীভাবে রুম নামের সিনেমাটি এই আলাপে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠল।
মানবসভ্যতায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্যতম ফসল হলো নগরায়ণ। তুলনামূলক উন্নত জীবনযাপনের আশায় মানুষ নগরমুখী। বাড়ছে শহরের জনসংখ্যা, তুলনায় ভূমি সীমিত। বাংলাদেশে আবাসনের ক্ষেত্রে এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর একটি হলো, স্বল্প জায়গায় কীভাবে ভালো বাড়ি বানানো যায়। সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে যেতে হবে আরেকটি প্রশ্নের কাছে। ৮৪ বছর বয়সী বিশ্বখ্যাত ইতালীয় স্থপতি রেনজো পিয়ানোর কাছে প্রশ্নটি করেছিলেন এক সাংবাদিক। রেনজো বানিয়েছেন ইংল্যান্ডের লন্ডন ব্রিজ টাওয়ার (দ্য শার্ড বা দ্য শার্ড অব গ্লাসেস), যুক্তরাষ্ট্রের হুইটনি মিউজিয়াম অব আমেরিকান আর্টের মতো সব স্থাপনা! সেসবের উল্লেখ করেই সেই সাংবাদিক রেনজোকে বলেছিলেন, ‘বিশ্বের অনেক বড় বড় স্থাপনা আপনার হাতে হয়েছে। আপনাকে যদি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য বাড়ি বানাতে বলা হয়, সেটা কীভাবে করবেন।’ উত্তরে রেনজো কেবল তিনটি কথা বলেছিলেন, ‘পেইন্ট ইট হোয়াইট। মেক ইয়োর উইনডোজ বিগার। অ্যান্ড ইউজ লেস ফার্নিচার।’ মানে, দেয়ালগুলো সাদা রং করুন। বড় বড় জানালা রাখুন। আর একান্তই যে আসবাবগুলো দরকার, কেবল সেগুলো রাখুন।
সাধারণভাবে যেকোনো বাড়ির জন্যই এই তিনটি বাক্য প্রযোজ্য। আর সেটি যদি হয় কম জায়গায়, তাহলে আরও বেশি করে প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, সাদা বা হালকা যেকোনো রং ব্যবহারে জায়গাটা বড় দেখায়। গাঢ় রং ও একাধিক রঙের ব্যবহারে জায়গা ছোট বলে মনে হয়। দ্বিতীয়ত, বড় জানালা থাকলে বাড়ির অন্দর আর বাইরের ভেতর সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেই জানালা দিয়ে বাইরের এক চিলতে আকাশও ঘরে ঢুকে পড়ে। জানালা দিয়ে দৃষ্টি অনেক দূর যাওয়ায় ‘সাইকোলজিক্যালি’ স্পেসটা বড় বলে মনে হয়। আর তৃতীয়ত, ভেতরে যত কম আর হালকা আসবাব ব্যবহার করবেন, ততই দৃষ্টি ঘোরাফেরা করতে পারবে। যত দৃষ্টি ঘোরাফেরা করতে পারবে, জায়গা তত বড় মনে হবে।
তাত্ত্বিক জ্ঞান ও বিধিমালা বড় বা ছোট, যেকোনো বাড়ির ক্ষেত্রে একইভাবে প্রযোজ্য। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যেকোনো প্রকল্পে স্থপতির দায়বদ্ধতা ও দৃষ্টিকোণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক জেবুন নাসরীন আহমদ বলেন, একজন স্থপতি কোনো প্রকল্পের পরিকল্পনাকালে অনেকগুলো সূক্ষ্ম বিষয় সম্পর্কে সচেতনভাবে চিন্তা করেন। নির্মাণ উপাদানের দাম থেকে শুরু করে নির্মাণপ্রযুক্তি ও কৌশল, পরিবেশের ওপর ন্যূনতম প্রভাব ও সম্ভাব্য দূষণ রোধ, ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ সুবিধা—এগুলো সবই সেই চিন্তার অন্তর্ভুক্ত। এরপর যোগ করলেন, ‘তবে আমি যে বিষয়টিতে সবচেয়ে জোর দিতে চাই তা হলো, প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাহুল্য বর্জন। মানে পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যেন ন্যূনতম অপচয়ও না হয়। তবেই প্রকল্পটি টেকসই হবে। একজন স্থপতিকে প্রকল্পের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে কাজ করতে হয়। ক্লায়েন্টের চাহিদা, স্টেকহোল্ডার ও অন্যান্য প্রফেশনালের সীমাবদ্ধতা, এসব স্থপতিকেই সমন্বয় করতে হয়। তাই সম্পদের ন্যূনতম অপচয় বা বাহুল্য রোধের জন্য সবাইকে ঐকমত্য আনার দায়ভারও স্থপতিকেই নিতে হবে।’
কম জায়গায় ভালো বাড়ি বানাতে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন স্থপতি মাহমুদুল আনোয়ার। চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক সেই পরামর্শগুলোতে—
‘স্বল্প জায়গা’ বিষয়টি আপেক্ষিক। অভ্যাসগত ও সংস্কৃতিকভাবে এই ধারণা একেকজনের জন্য একেক রকম। হংকংয়ের এক লোকের কাছে দুই হাজার বর্গফুটের বাড়ি মানে বিরাট বাড়ি। সেই একই বাড়ি একজন মার্কিন নাগরিকের জন্য কোনোরকমে চলনসই। আবার যিনি গ্রামের উঠান বাড়িতে থেকে অভ্যস্ত, যাঁর দৃষ্টিতে নিয়মিত ধরা দেয় বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ, তিনি ঢাকার একটা ‘বড়’ অ্যাপার্টমেন্টে উঠেও হাঁসফাঁস করতে পারেন।
কম জায়গায় বসবাসের একটি ‘মানসিক চাপ’ আছে। যদি দৃষ্টি ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পায়, সে ক্ষেত্রে সেই চাপ সামাল দেওয়া সহজ হয়। যেমন বিকেলে বারান্দা থেকে যদি এক কাপ চা হাতে খোলা জায়গা দেখা যায় বা জানালা দিয়ে বাইরে দেখা যায়, সেটা কম জায়গার একঘেয়েমি থেকে অনেকটাই মুক্তি দেয়।
বাড়ির জায়গা থেকে বড় ব্যাপার হলো প্রতিটি ইউনিটে কেমন জায়গা পড়ছে। যেমন একটি ১০ কাঠার জায়গায় যদি পাঁচ–পাঁচটি ইউনিট করে বাড়ি তোলা হয়, তাহলে প্রতিটি ইউনিটের জায়গা হলো দুই কাঠা করে। ফলে অ্যাপার্টমেন্টপ্রতি জায়গা বেশ কমে গেল। আবার সেখানে যদি কেবল একটি বাড়ি করা হয়, তাহলে সেটি যথেষ্ট জায়গা পাবে।
জায়গা কম থাকলেও মানসিকভাবে যেন মনে না হয় যে জায়গা কম, সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। এর সঙ্গে নকশা, রং, বাইরের আলো–বাতাস ভেতরে কতটা ঢুকছে, বাইরে কত দূরে দৃষ্টি যাচ্ছে—এ রকম নানা কিছু যুক্ত।
একেবারেই সাধারণ প্রয়োজন পূরণের জায়গাটুকু থাকতে হবে। নয়তো দীর্ঘ সময়ের ব্যবহারে সেটি মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যেমন জাহাজ বা ট্রেনের ছোট একটি জায়গায় বসে দিব্যি ভ্রমণ করা যায়। কিন্তু ওই জায়গাটুকু দিনের পর দিন বসবাসের জন্য ব্যবহার করা যায় না। প্লেনের টয়লেট যাত্রীদের জন্য ঠিক আছে। কিন্তু সেটি যদি দিনের পর দিন ব্যবহার করতে হয়, সেটি আবার ঠিক হবে না।
একই স্পেস আর আসবাবের একাধিক ব্যবহার। যেমন অনেকের বাড়িতেই ড্রয়িংরুমে একটি বেড পাতা থাকে। হুমায়ূন আহমেদের একাধিক নাটকেও এ রকম দেখা গেছে যে ড্রয়িংরুমের বেডের ওপর বসে গল্প করছে। আবার সেই বেডেই রাতে ঘুমানো হচ্ছে। ডাইনিং আর ড্রয়িং—এ দুটি রুমের বদলে একটি হলরুম থাকতে পারে। এর এক পাশে থাকতে পারে রান্নাঘর।
ভাঁজ করা আসবাব ব্যবহার করা যেতে পারে। যেমন জাপান, চীন, হংকং—এই দেশগুলো কম জায়গায় চমৎকার সব বাড়ি করেছে। আর সেখানকার মানুষও ছোট বাড়ির লাইফস্টাইলের ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। আমাদেরও এমন বাড়ির জীবনযাত্রার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া শিখতে হবে।
যে বাড়ির জায়গা কম, সেই বাড়ির মানুষ দেখা যায় চায়ের দোকানে জড়ো হয়ে গল্পগুজব করে। যে এলাকার বাড়িগুলো ছোট ছোট, সেখানকার বাজার সংস্কৃতিটা ভিন্ন। মানুষ বাইরে আড্ডা দেয়। আড্ডা দেওয়ার মতো টংঘর, কফি শপের সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে।
যে অঞ্চলের জনসংখ্যা বেশি, আবাসনের ওপর ভীষণ চাপ, সেখানে ভিন্নভাবে নগরায়ণ প্রকল্প করা যায়। যেমন কিছুক্ষণের জন্য কল্পনা করুন, ঢাকা থেকে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস ও কারখানা রাজশাহীতে নিয়ে যাওয়া হলো। সে ক্ষেত্রে রাজশাহীতে জনসংখ্যার ঘনত্ব বাড়বে। ঢাকায় কমবে। ফলে আবাসনের ওপর চাপটা খানিকটা ভারসাম্য পাবে।
লেখক: স্থপতি