ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.
সমস্যা
আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। একটি মেয়েকে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু একদিন ঘটনাচক্রে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে গেলে সাতজন ছেলের দল রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ওরা আমাকে ধরে মারে। আমার সামনে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে। তারপর গ্রামের লোক জড়ো হলে ওরা পালিয়ে যায়। কিন্তু গ্রামজুড়ে রটে যায় আমরা ‘ধরা খেয়েছি’। মেয়ের মা-বাবা আমার নামে মামলা করার হুমকি দেন। ঘটনার পর অনেক দিন পাগলের মতো কেঁদেছিলাম।
ওকে বিয়ে করার জন্য আমার মা-বাবাকে পাঠাই। ওরা অকারণে আমার মা-বাবাকে অপমান ও গালিগালাজ করে। পরে আমরা গোপনে বিয়ে করি। এর ফলে আমার আত্মীয়স্বজন সবাই আমার বিরুদ্ধে চলে যায়। পরে আমি ঢাকায় চলে আসি। এরপর মেয়েটির সঙ্গে অন্য ছেলের সম্পর্ক হয়। সে আমাকে ছেড়ে চলে যায়। আমি আমার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে মিল করতে চাইলেও তারা আর আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ফলে আমি একূল-ওকূল দুকূলই হারাই। এরপর শুরু হয় আমার দুঃসহ জীবন।
আমি এখন কোনো ধর্ষণ, নির্যাতন বা খুনের সংবাদ দেখতে পারি না। কোনো মেয়ের দিকে তাকাতেও পারি না। আমার সঙ্গে বহু মেয়ে সম্পর্ক করতে চাইলেও আমি পারছি না। ওকে শুধু মনে পড়ে। ওরা আমাকে মেরেছিল। এ কারণে আমার একটি কানের পর্দা নষ্ট হয়ে গেছে। বাঁ পায়ে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। রাত হলে আমি ঠিক থাকতে পারি না। কখনো প্রতিশোধের নেশায়, কখনো কষ্টে। ধর্ষণকারীদের ছবি আমার চোখে ভাসে। আমি মানসিক হাসপাতালে চিকিত্সা নিয়েছি। ওরা কাউন্সেলিংয়ের জন্য ডাকবে বলেও ডাকেনি। পরে শুনেছি, ওই মেয়েটি অনেক ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক করেছে। তাই ওকে ফিরিয়ে নেব, এমনটাও ভাবতে পারছি না। আমি সব ভুলে যেতে চাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক
পরামর্শ
তোমার জীবনে কম সময়ের ব্যবধানে খুব ভীতিকর, অপমানজনক ও যন্ত্রণাদায়ক বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। এত কিছুর পরও তুমি যে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছ, এ থেকে বোঝা যায়, এখনো তোমার মনের শক্তি রয়েছে। তোমার ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার’ হয়েছে। তীব্র ভীতিকর অভিজ্ঞতার পর কারও এ ধরনের অসুস্থতা হতে পারে। তুমি খুব সংবেদনশীল বলে হয়তো এই মানসিক চাপগুলো মোকাবিলা করতে পােরানি।
যত দ্রুত সম্ভব ওষুধ সেবনের পাশাপাশি কাউন্সেলিংয়ের সেবা গ্রহণ করো।
মনোরোগের চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে তোমার বিষণ্নতা, দুশ্চিন্তাগুলো কমবে এবং ঘুমও ভালো হবে। সেই সঙ্গে কাউন্সেলিংয়ের সেবা তোমাকে বেশ কিছুদিন ধরে নিতে হবে। অবস্থার উন্নতি ঘটতে থাকলে চিকিত্সক ধীরে ধীরে ওষুধ কমিয়ে দেবেন।
তবে যত দিন পর্যন্ত তোমার দুঃস্বপ্ন, ভয়, ঘটনার ছবি দেখার ব্যাপারগুলো না কমে, তত দিন কাউন্সেলিং সেবা গ্রহণ করতে হবে।
এ অসুস্থতায় অতীতের ভীতি সঞ্চারকারী ঘটনাগুলোর স্মৃতি ও অনুভূতিগুলো সহ্য করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে।
কাউন্সেলররা সাইকোথেরাপির বিভিন্ন কৌশলের সাহায্য নিয়ে একটি নিরাপদ পরিবেশে অসুস্থ মানুষটিকে বারবার ঘটনাগুলোর বর্ণনা করতে সহায়তা করেন। এর ফলে ব্যক্তি তার ভাবনা ও অনুভূতিগুলোর ওপর আরও ভালো নিয়ন্ত্রণের সক্ষমতা অর্জন করে। তখন আর চাপমূলক ঘটনার স্মৃতিগুলোকে এতটা ভয় পায় না। সে সচেতনভাবে চিহ্নিত করতে পারে কোন ঘটনাগুলো অতীতের স্মৃতিগুলো আবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
এ ছাড়া একই ধরনের অসুস্থতায় যাঁরা কষ্টে রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে দলীয় থেরাপির সহায়তায় মানসিক শক্তি ও সাহস তৈরি হয়। তুমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের পঞ্চম তলায় এডুকেশনাল ও কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগে অথবা চতুর্থ তলায় নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটে গিয়ে বেশ কিছু সেশন নিতে পার। আশা করি উপকৃত হবে।