এটা আমার দ্বিতীয় শান্তি পুরস্কার

১৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশের কিশোর সাদাত রহমান। নড়াইল আবদুল হাই সিটি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র সে। সাইবার টিনস নামে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে ভূমিকা রাখার কারণে সাদাতকে এই পুরস্কার দিয়েছে আন্তর্জাতিক সংগঠন কিডস রাইটস। পুরস্কার নিতে নেদারল্যান্ডসে গেছে সাদাত রহমান। গতকাল ১৪ নভেম্বর সকালে হোয়াটসঅ্যাপে তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাইফুল্লাহ

সাদাত রহমান
ছবি: কিডস রাইটসের ওয়েবসাইট
প্রশ্ন:

নেদারল্যান্ডসে তো বোধ হয় এখনো সকাল হয়নি। ঘুম ভেঙে গেছে, নাকি খুশিতে ঘুম হচ্ছে না?

এখন বাজে ভোর সাড়ে ছয়টা। বাংলাদেশের সময়ের সঙ্গে যেহেতু মেলে না, এমনিতেই গত কয়েক দিন রাত তিনটায় ঘুম ভেঙেছে। আর আজকে রাতে ঘুমই হয়েছে এক ঘণ্টার মতো। পুরস্কারটা বিছানার পাশে ছিল। বারবার চোখ খুলে দেখছিলাম, জায়গামতো আছে কি না। গত বছর এই পুরস্কার পেয়েছে গ্রেটা থুনবার্গ। এ বছর আমি পেয়ে গেলাম, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না! নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড় থেকে আমি এত দূর পৌঁছে যাব, কখনো ভাবিনি। ভেবেছিলাম হয়তো মনোনয়নটুকুই পাব, তাতে আমার কাজ নড়াইলের বাইরেও দেশের অন্যান্য জেলায় ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হবে। এটুকুতেই খুশি ছিলাম।

প্রশ্ন:

পুরস্কার পাওয়ার পর বক্তৃতা দিতে গিয়ে সব কথা ইংরেজিতে বললেও শেষে তুমি বাংলায় বলেছ ‘সবাই ভালো থাকবেন’। এটা কি পরিকল্পনায় ছিল?

না। ওটা স্ক্রিপ্টে ছিল না। সব সময় বক্তৃতার শেষে এ কথা বলি, এখানেও বলে ফেলেছি। তবে সবাই খুশিই হয়েছে। করোনার কারণে অনুষ্ঠানটা হয়েছে খুব ছোট পরিসরে। এখানে এত ঠান্ডা, স্যুট পরেও আমি রীতিমতো শীতে কাঁপছিলাম। মানুষের সামনে কথা বলতে আমার ভালো লাগে। কিন্তু ক্যামেরার সামনে কথা বলতে অস্বস্তি লাগে।

প্রশ্ন:

তুমি কেন সাইবার বুলিং প্রতিরোধে অ্যাপ তৈরি করার কথা ভাবলে?

বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ শিশু-কিশোর কোনো না কোনোভাবে সাইবার বুলিংয়ের শিকার। অথচ এর কোনো প্রতিকার হয় না। কারণ, বুলিংয়ের শিকার হলে আমরা কাউকে বলতে পারি না। মা-বাবারা ছোট বাচ্চাদের বলেন, ‘তাড়াতাড়ি খাও, না হলে পুলিশ আসবে। ঘুমাও, নয়তো পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে,’ তাই ছোটবেলা থেকে আমরা পুলিশকে বন্ধু ভাবতে পারি না। কোথাও প্রতিকার না পেয়ে কেউ আত্মহত্যা করে, কেউ হতাশায় পড়ে, মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায়। কদিন আগে বিউটি মণ্ডল নামের একটা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। ওর ছবি এডিট করে একজন ফেসবুকে ছড়িয়ে দিয়েছিল। মেয়েটার তো কোনো দোষ ছিল না। ওর মা-বাবা অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দিতে চেয়েছে তা নয়। স্কুলে পড়ছে। সব ঠিক ছিল। একটা ঘটনা জীবনটা ওলটপালট করে দিল। বিউটির মতো মেয়েরা যেন পুলিশের কাছে যেতে না চাইলেও তার অভিযোগটা অন্তত জানাতে পারে, সে জন্যই আমাদের সাইবার টিনস অ্যাপ।

প্রশ্ন:

তোমাদের কাজে চ্যালেঞ্জ কী ছিল?

কাজটা কিন্তু বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কারও যদি অ্যাকাউন্ট হ্যাক হয় বা তথ্যপ্রযুক্তিগত সমস্যা হয়, শুরুতে আমরা সমাধান করার চেষ্টা করি। সম্ভব না হলে তখন পুলিশকে জানাই। এখন পর্যন্ত ৮ জন অপরাধীকে আমরা ধরিয়ে দিতে পেরেছি। আমি তো বলি, এটা আমার দ্বিতীয় শান্তি পুরস্কার। প্রথম যখন একজন অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে পেরেছিলাম, সেটা ছিল আমার প্রথম শান্তি পুরস্কার।

অনুষ্ঠানের মঞ্চে নতুন স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শুভেচ্ছা বিনিময়
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

ছোটবেলা থেকেই তো তুমি নানা কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। কিছু কাজের কথা বলবে?

আমার বাবা একজন পোস্টমাস্টার। বাবার চাকরির সুবাদেই তিন বছর পরপর আমাকে এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেতে হয়েছে। ফরিদপুর, পটুয়াখালী, সাতক্ষীরায় থেকেছি। ক্লাস সেভেন থেকে ওয়েব ডেভেলপমেন্টে আগ্রহ ছিল। তখন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ শুরু করি। ছবি বানানোর প্রতি আমার আগ্রহ আছে। স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়ে ভারতের সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটের পুরস্কারও পেয়েছি। সাতক্ষীরায় আমি প্রথম আলো বন্ধুসভার সঙ্গে ছিলাম। যশোরে যখন আমার সংগঠন নড়াইল ভলান্টিয়ার্সকে নিয়ে সাইবার বুলিংয়ের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করি, মানুষ আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। বলেছে, তুমি পড়াশোনা করো, ওসব কাজ পুলিশ করবে। এখন আশা করি, সবাই আমার কথা বুঝবে।

প্রশ্ন:

তিন বছর পরপরই যেহেতু ঠিকানা বদলে যায়, নড়াইল ছেড়ে যেতে কষ্ট হবে না?

আমার বাবার কিন্তু কুষ্টিয়ায় বদলি হয়ে গেছে। আমি যেহেতু নড়াইলে কলেজে পড়ছি, তা ছাড়া করোনার কারণে আমার যাওয়া হয়নি। নড়াইল আমার শহর নয়, কিন্তু এটাই এখন আমার শহর হয়ে গেছে। এখানে চিত্রা নদীর আবহে একটা শান্তি আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, মাশরাফি ভাই (মাশরাফি বিন মুর্তজা) আছেন। নড়াইলের তরুণদের সঙ্গে তিনি এমনভাবে মেশেন, মনেই হয় না তিনি এত বড় মানুষ। নড়াইল ছেড়ে যেতে একটু কষ্ট তো হবেই। কিন্তু এখন তো আমি বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ছড়িয়ে পড়তে চাই। ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে কাজ করতে চাই। আপনি দেখেন, বাংলাদেশে সাইবার বুলিংয়ের শিকার ছেলেমেয়ের হার ৪৯, যুক্তরাষ্ট্রে সেটা ৫৯ শতাংশ। তার মানে, সারা বিশ্বেই সাইবার বুলিং প্রতিরোধে কাজ করা প্রয়োজন। পুরস্কার পাওয়ার পর ইতিমধ্যে আমার সঙ্গে ইউরোপের পুলিশ কথা বলেছে। ইন্টারপোলকেও তারা যুক্ত করেছে। আমার কী কী সাহায্য লাগবে, সেটা তারা শুনেছে।

প্রশ্ন:

এখন সামনে কী পরিকল্পনা?

আমাদের অ্যাপটা আরও উন্নত করা হচ্ছে। সাইবার বুলিং প্রতিরোধের পাশাপাশি আমি অভিভাবক, ছেলেমেয়েদের মানসিকতা পরিবর্তনে কাজ করতে চাই। আমরা নড়াইলে বসে কাজ করতাম। ঢাকার সাইবার টিমের সহায়তা সেভাবে পাইনি। এখন আশা করি পাব। দেশের তারকাদের নিয়ে একটা নেটওয়ার্ক করতে চাই। ধরুন, কেউ বুলিংয়ের শিকার হয়ে ভেঙে পড়ল, তার প্রিয় তারকা কে, সেটা যদি আমাদের জানা থাকে, সেই তারকা যদি ফোন করে কিছু অনুপ্রেরণামূলক কথা বলেন, তাহলে হয়তো সে মানসিকভাবে একটু জোর পাবে। দেখুন, আমি কিন্তু আর্টসের ছাত্র। কিন্তু পুরস্কার পেয়েছি তথ্যপ্রযুক্তিসংক্রান্ত উদ্ভাবনের কারণে। এর অর্থ হলো, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। সারা বিশ্বেই সেটা প্রমাণ করতে হবে।

প্রশ্ন:

আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারকে বলা হয় ‘শিশুদের নোবেল’। তুমি যাঁর কাছ থেকে পুরস্কার পেয়েছ, সেই মালালা ইউসুফজাই ২০১৩ সালে শিশুদের নোবেল পেয়েছেন, আবার পরের বছর বড়দের নোবেলও পেয়েছেন। তুমিও কি সে রকম কিছু ভাবছ?

নাহ্। পুরস্কারের আশায় কিছু করলে পাওয়া হয় না, সেটা আমি আগেও দেখেছি। ছোটবেলায় কত কুইজে অংশ নিতাম পুরস্কারের আশায়, কখনো পাইনি। যেখানে আশা করিনি, সেখানেই পেয়েছি।