২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

একরোখা শিশু সামলাবেন কীভাবে?

সন্তানের জেদ প্রশ্রয় দেবেন না। মডেল: রিহাল ও শিখা, ছবি: কবির হোসেন
সন্তানের জেদ প্রশ্রয় দেবেন না। মডেল: রিহাল ও শিখা, ছবি: কবির হোসেন

নয় বছরের তমালকে (ছদ্মনাম) নিয়ে তো প্রায়ই বিপদে পড়তে হয় ওর বাবা-মায়ের। শপিং মলে গেলে কোনো কিছু কেনা তার চাই-ই চাই। আর সেটা না কিনে দিলে মাটিতে গড়াগড়ি। সবার সামনেই চিৎকার, কান্নাকাটি—সে এক হুলুস্থুল অবস্থা। আদর দিয়ে, ধমক দিয়ে, বুঝিয়ে—নানাভাবেই চেষ্টা করে দেখেছেন, কোনোভাবেই তমালকে বোঝানো যায় না। ফলে চাহিদামতো জিনিস তাকে কিনে না দিয়ে কোনো উপায়ও থাকে না।
অপর দিকে ছয় বছরের ছোট্ট মিথিলা (ছদ্মনাম) খুব মিষ্টি হলেও খাওয়া, পড়া সবকিছুতেই তার জেদ ধরা চাই। একবার না বললে কোনোভাবেই যেন সেটা হ্যাঁ হবে না। মনোবিজ্ঞানে কিছু শিশুকে বলা হয় ‘সহজে মানানো যায় না এমন শিশু’ বা ‘ডিফিকাল্ট চাইল্ড’। ১০ শতাংশ শিশু এমন হয়ে থাকে। এ ধরনের বাচ্চারা অল্পতেই উত্তেজিত হয়। একরোখা হয়। সহজে কথা শোনে না বা সন্তুষ্ট হয় না। মনোবিজ্ঞানী চেস ও থমাসের মতে, ৪০ শতাংশ শিশুকে বলা হয় ‘সহজে মানানো যায় এমন শিশু’। যাদের খাওয়া, ঘুম, বাথরুম ইত্যাদি সবকিছুই একধরনের নিয়মের মধ্যে থাকে। এরা যেকোনো কথা সহজে শোনে। এ দুই ধরনের বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ থাকে বাকি ৫০ শতাংশ শিশুর মধ্যে।
একরোখা ভাব বা যেকোনো কিছু নিয়ে জেদ করা অনেক শিশুরই বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য। কোনো কিছু চাইলে সেটা দিতেই হবে, যেকোনো কিছুতেই তারস্বরে চেঁচানো, জিনিসপত্র নষ্ট করা ইত্যাদি তাদের যেন জেদেরই বহিঃপ্রকাশ।
শিশুদের জেদ কেন হয়—এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যায়, জন্মগতভাবে পাওয়া বৈশিষ্ট্য এবং চারপাশের পরিবেশের প্রভাবেই বিকশিত হতে থাকে শিশুর মনের গঠন। অর্থাৎ, তার সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হচ্ছে, তার কোনো ব্যবহার বা আচরণ আমাদের মাধ্যমে অজান্তে উৎসাহ পাচ্ছে কি না, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে তার মেলামেশা, চারপাশে সে কী দেখে বড় হচ্ছে ইত্যাদি নানা কিছুই প্রভাব ফেলে তার মনে। এরই প্রতিফলন দেখি শিশুর আচরণে।

মনোবিজ্ঞানের একটা নিয়ম হলো, সন্তানের যেসব আচরণে মা-বাবা মনোযোগ দেবেন, সেসব আচরণ সে বারবার করবে। এই মনোযোগ যেমন আমরা আদর বা প্রশংসা করা, দাবি পূরণ করার মাধ্যমে দিতে পারি, তেমনি ‘বকা দেওয়া’, ‘বোঝানো’র মাধ্যমেও হতে পারে। যেমন, কোনো বাচ্চা কোনো কিছু কেনার জন্য জেদ করলে তাকে সেটা কিনে দিলে তার জেদ করার প্রবণতা আরও বাড়বে।
আবার কেউ যদি কোলে ওঠার জন্য মাটিতে গড়াগড়ি দেয় আর কেউ তাকে কোলে তুলে নেয়, তাহলে তার গড়াগড়ি দেওয়ার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণটি মনোযোগ পাবে। পরে এ আচরণটি আরও বাড়বে। এমনকি শিশুদের দুষ্টুমি নিয়ে বা জেদ নিয়ে তাদের সামনে অন্যদের সঙ্গে গল্প করলেও শিশুর এসব আচরণে পরোক্ষভাবে উৎসাহ দেওয়া হয়।

সন্তান জিনিসপত্র নষ্ট করলে ওর কিছু চাহিদা কম পূরণ করা ভালো। মডেল: ফারহান
সন্তান জিনিসপত্র নষ্ট করলে ওর কিছু চাহিদা কম পূরণ করা ভালো। মডেল: ফারহান

তাহলে একরোখা শিশুদের সামলাতে কী করা উচিত? শিশু যখন জেদ করে সবার সামনে কান্নাকাটি করতে বা গড়াগড়ি দিতে থাকবে, তখন তার দাবি না মেটালে সামলাবেন কীভাবে? অথবা জেদ করে যখন না খেয়ে থাকবে, তখন তার ইচ্ছা পূরণ না করেই বা উপায় কী?
আচরণ যেমন মনোযোগ দিলে বাড়ে, আবার যেকোনো ব্যবহার, আচরণ যদি ক্রমাগত উপেক্ষা করা হয়, তাহলে সেসব আচরণ কিন্তু কমে যাবে।
সুতরাং শিশুর কোনো আচরণ পছন্দ না হলে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। অর্থাৎ, বাচ্চা জেদ করলে তাকে বকা দেওয়া, বোঝানো, দাবি পূরণ করা, তাকে কটাক্ষ করা ইত্যাদি থেকে নিজেকে বিরত রাখুন এবং সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন। ধৈর্য ধরে দৃঢ়তার সঙ্গে ক্রমাগত যেকোনো জেদে এমন আচরণ করতে পারলে শিশু বুঝে যাবে যে জেদ করে কোনো কিছু আদায় করা যায় না। ছোটখাটো জেদকে প্রশ্রয় না দিয়ে এ অভ্যাসটি শুরু করুন ঘর থেকেই।
একটা জনপ্রিয় প্রশ্ন হলো, ক্ষেত্রবিশেষে শিশুরা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় (যেমন বেয়াদবি করা, জিনিসপত্র নষ্ট করা ইত্যাদি), তখন শাস্তি কতখানি গ্রহণযোগ্য? উত্তর হলো, ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি সাময়িকভাবে কার্যকর হলেও শিশু এ ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষা গ্রহণ করে না। বরং বারবার শাস্তি দিলে শাস্তির গুরুত্ব কমে যায়। শিশুমনে একধরনের নেতিবাচক আবেগ তৈরি হয়।
সুতরাং শাস্তিযোগ্য কোনো কাজে শাস্তির পরিবর্তে সন্তানের কিছু সুবিধা (যেমন আদর করা, কথা বলা, প্রশংসা করা, উপহার দেওয়া) ইত্যাদি সাময়িকভাবে কমিয়ে ফেলুন।
কী করবেন?
* শিশুর যেকোনো ভালো কাজে প্রশংসা করুন।
* পড়ালেখার পাশাপাশি সাধারণ আচরণ, নিয়ম-কানুন শেখান।

* সামাজিক পরিবেশে কোন ধরনের আচরণ গ্রহণীয় এবং কোনগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, সেটা স্পষ্ট করে জানান।
* সমবয়সী শিশুদের সঙ্গে মিশতে দিন। তার জিনিসপত্র শেয়ার করতে শেখান।
* যেকোনো জেদ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন।

কী করবেন না?
* যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করুন।
* জেদে অতিরিক্ত বোঝানো, বকা দেওয়া বা তিরস্কার করবেন না।
* জেদ নিয়ে বাচ্চার সামনে অন্যদের সঙ্গে গল্প করবেন না।
* জেদ করে কোনো কিছু চাইলে সেই দাবি পূরণ করবেন না। স্বাভাবিকভাবে চাইলে তখন দেবেন।

মেখলা সরকার : মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সহকারী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা