এক জুবায়ের, লাখো গাছ

জুবায়ের আল মাহমুদ
জুবায়ের আল মাহমুদ
ছবি: খালেদ সরকার

সারা দেশের ৭৫০টি বিদ্যালয়ের আড়াই লাখ শিক্ষার্থী গাছের চারা রোপণের এক ব্যতিক্রমী উদ্যোগে শামিল হয়েছে। নিজেদের টিফিনের বাঁচানো পয়সায় এই খুদে শিক্ষার্থীরা প্রত্যেকে এখন গাছের মালিক। ব্যতিক্রমী উদ্যোগের পেছনের মানুষ জুবায়ের আল মাহমুদ এবং তাঁর সৃজনশীল মানুষ গড়ার আন্দোলন—আলোর মিছিল।

২০১৫ সালের কথা। ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে চলছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সে সম্মেলন নিয়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে ব্যাপক শোরগোল হলো। বিশ্বনেতাদের বক্তৃতায় উঠে এল—বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশের তালিকা। সে তালিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশটির নাম বাংলাদেশ। বিষয়টি নাড়া দিল বাংলাদেশের জুবায়ের আল মাহমুদকে। তিনি ভাবতে শুরু করেন জলবায়ু পরিবর্তন কী এবং কেন? সমাধানের উপায়ই–বা কী।

বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো পড়ে জুবায়েরের মনে হলো, প্রিয় পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে, একে শীতল করতে হবে। আর এটা করতে পারলেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে বাঁচানো যাবে বাংলাদেশকে। তরুণ জুবায়ের আরও ভাবলেন, এ জন্য নিজের সাধ্যের মধ্যেই কিছু করার। জুবায়ের বলছিলেন, ‘উদ্যোগ নিলাম গাছের চারা রোপণের। এ তো জানা কথা, অক্সিজেনের মাত্রা বাড়লেই পৃথিবী শীতল হবে। আর এর মোক্ষম অস্ত্র হচ্ছে গাছ।’

আর এ কাজের জন্য বেছে নিলেন তাঁর পুরোনো জায়গাকেই। ‘আলোর মিছিল’ নামের সে উদ্যোগকে তিনি বলেন, ‘সৃজনশীল মানুষ গড়ার আন্দোলন’। যার গোড়াপত্তন ২০১১ সালে। 

গাছের চারা বিতরণ উৎসব
গাছের চারা বিতরণ উৎসব


আলোর মিছিল
ঘরের বাইরে যেমন বিশাল পৃথিবী, তেমনি তো পাঠ্যবইয়ের বাইরে পড়ে রয়েছে জ্ঞানের অসীম ভান্ডার। কিন্তু জুবায়ের দেখলেন, বিদ্যালয়গুলোতে আগে শুধু পাঠ্যবই পড়ানো হচ্ছে। সে সময় জুবায়ের বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সন্ধান দেন জ্ঞানের অসীম ভান্ডারের। তবে তা এক দিনে হয়নি। স্কুলশিক্ষার্থীদের জ্ঞানচর্চার এই জগতে নিয়ে আসার এক আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছিল। এখন সে আন্দোলনে শরিক হয়েছে রাজশাহী ও নাটোরের তিনটি উপজেলার ৪১টি বিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এই আন্দোলনের নাম দেন ‘আলোর মিছিল’। জুবায়ের বলছিলেন, ‘এর মধ্যে আমরা ১৮টি বিদ্যালয়ে পাঠাগার তৈরি করে দিই। সরবরাহ করি বই।’

এই বই সংগ্রহ করেছিলেন বন্ধুদের টাকায়। ২০১১ সালে তখন তিনি রাজশাহী শহরে থেকে পড়াশোনা করেন। পরিচিত বন্ধুদের মাধ্যমে পাঠক চক্র তৈরি করেন। এই চক্রের সদস্যরা প্রতি মাসে ১০ টাকা চাঁদা দিতেন। চক্রে প্রায় ১০০ জন সদস্য হন। প্রতি মাসে তাঁদের কাছ থেকে প্রায় ১ হাজার টাকা ওঠে। এই টাকা দিয়ে মাসে মাসে তিনি বই কেনেন। আর বিদ্যালয়ে বিতরণ করেন।

জুবায়ের এখন একটি বেসরকারি টেলিভিশনের প্রতিবেদক। থাকেন ঢাকায়। তবে এখনো রয়েছে সেই বইয়ের আলো ছড়ানোর কার্যক্রম। নিত্যদিনের ব্যস্ততা শেষে ঠিকই সময় করে নেন আলোর মিছিল দীর্ঘ করতে। সে কাজের সঙ্গে ২০১৫ সালে যুক্ত হয় বৃক্ষরোপণ আন্দোলন। 

শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিচ্ছেন জুবায়ের
শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দিচ্ছেন জুবায়ের


টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে গাছ
২০১৫ সালে উদ্যোগের প্রথম পর্যায়ে উত্তরাঞ্চলের সেই ৪১টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে গেলেন জুবায়ের। তাদের মাধ্যমে রোপণ করলেন ১৭ হাজার গাছের চারা। তবে বই তাদের বিনা মূল্যে দিলেও গাছ দিলেন না। তাহলে কীভাবে হলো? জিজ্ঞেস করি জুবায়েরকে। তিনি খোলাসা করেন, ‘বৃক্ষরোপণের কাজটি সহজ করতে একটি মূলমন্ত্র দাঁড় করিয়েছিলাম। তা ছিল, এক দিনের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে শিক্ষার্থীরা গাছ রোপণ করবে। আমার ভাবনা শুনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তা দারুণভাবে গ্রহণ করল।’

শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে বৃক্ষরোপণের এই প্রাথমিক সাফল্য তাঁর চোখ খুলে দেয়। এরপর তিনি বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) বিষয়টি বোঝানো শুরু করেন। একজন ইউএনও এই উদ্যোগে রাজি হলে তিনি উপজেলার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়ে একটি সভা ডাকেন। সেই সভায় জুবায়ের শিক্ষার্থীদের ‘এক দিনের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে গাছ রোপণ’–এর মূলমন্ত্র ব্যাখ্যা করেন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং এর হাত থেকে রক্ষা পেতে তাঁর উদ্ভাবিত এই পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন। একজন শিক্ষক যখন ধারণাটি গ্রহণ করেন তখন একটি বিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থী তা গ্রহণ করে। 

সিএফসি ফাইটার বক্স ও একটি স্বপ্ন পূরণ
 সিএফসি হচ্ছে ক্লোরোফ্লোরো-কার্বন গ্যাসের সংক্ষিপ্ত রূপ। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য এই গ্যাস অনেকটা দায়ী। তাই সিএফসি গ্যাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেই বৃক্ষরোপণের আয়োজন। অর্থ সংগ্রহের জন্য তহবিল বক্সের নামটাও তাই ‘সিএফসি ফাইটার বক্স’। শিক্ষকদের সভাগুলোতে জুবায়ের শিক্ষার্থীদের টিফিনের পয়সা ফেলার জন্য একটি বাক্স বিনা মূল্যে সরবরাহ করেন। একজন শিক্ষক এই বাক্স রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকেন। শিক্ষার্থীরা বছরের যেকোনো একটি দিন বাক্সে তার এক দিনের টিফিনের পয়সা জমা করে।

যা দিয়ে কেনা হয় গাছের চারা। উৎসব করে বিতরণ করা হয় শিক্ষার্থীদের হাতে। ২০১৬ সালে সারা দেশের ৮৭টি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায় ৩০ হাজার গাছ লাগায়। ২০১৭ সালে নাটোরের বড়াইগ্রাম, পাবনার ঈশ্বরদী, রাজশাহীর বাঘা ও চারঘাট উপজেলার ইউএনওদের উদ্বুদ্ধ করে তাঁদের মাধ্যমে শিক্ষদের নিয়ে সভা করেন। সেখানে জুবায়ের জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কথা বলার পাশাপাশি প্রামাণ্য চিত্র দেখান। এতে শিক্ষকেরা আরও বেশি উদ্বুদ্ধ হন। সে বছর এই চার উপজেলার ৬০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ১ লাখ ৪৫ হাজার গাছ লাগানো হয়। তার মধ্যে নাটোরের বড়াইগ্রামে ৮০ হাজার, ঈশ্বরদীতে ৩০ হাজার, বাঘায় ১৫ হাজার ও চারঘাটে ২০ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়।

২০১৮ সালে এই চার উপজেলার সঙ্গে নতুন করে যোগ হয়েছে খুলনার দিঘলিয়া উপজেলা ও সিলেটের বিয়ানীবাজার। এর মধ্যে দিঘলিয়া উপজেলার শিক্ষার্থীরা প্রায় ২৫ হাজার বৃক্ষরোপণ করেছে। আর পুরোনো উপজেলাগুলোর মধ্যে নাটোরের বড়াইগ্রামে ৩০ হাজার ও পাবনার ঈশ্বরদীতে ১৫ হাজার বৃক্ষরোপণ করা হয়েছে। আর বিয়ানীবাজারে বিদ্যালয়গুলো পরীক্ষার জন্য গাছ রোপণ শুরু হয়নি। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে বৈঠক শেষ হয়েছে।

বিদ্যালয়ে উৎসব আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের হাতে গাছের চারা তুলে দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত
বিদ্যালয়ে উৎসব আয়োজন করে শিক্ষার্থীদের হাতে গাছের চারা তুলে দেওয়া হয়। ছবি: সংগৃহীত

বেশ কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজ দায়িত্বে টিফিনের পয়সা জমা করে বৃক্ষরোপণ করেছে। চারঘাটের ডাকরা ডিগ্রি কলেজ তেমনই একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রউফ জানালেন, তাঁরা সিএফসি ফাইটার বক্সে জমানো শিক্ষার্থীদের টাকা দিয়ে এ বছর দুই শতাধিক গাছ কিনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। শিক্ষার্থীরা নিজের বাড়ির আঙিনায় সেসব গাছ রোপণ করেছে।

সময় যত গড়াচ্ছে, এই আন্দোলনে অংশ নিতে এগিয়ে আসছে দেশের নানা প্রান্তের মানুষ। আবার ইউএনওরা বদলি হলেও যুক্ত হচ্ছেন নতুন এলাকায় গিয়ে। এমনই একজন ইশরাত ফারজানা। ২০১৭ সালের নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার ইউএনও ছিলেন। যুক্ত হয়েছিলেন জুবায়েরের উদ্যোগের সঙ্গে। বর্তমানে জয়পুরহাট জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ফোনে কথা বলার সময় ইশরাত ফারজানা বলছিলেন, ‘জুবায়েরের পরিকল্পনা শুনেই আমি সহায়তা করতে রাজি হয়েছিলাম। এরপর শিক্ষকদের ডেকে একটা সেমিনার করলাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় যেদিন বৃক্ষরোপণ উৎসব হলো, সেদিন গাছের চারা হাতে পাওয়ার পর শিক্ষার্থীদের চোখমুখে যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তা আসলে নিজে চোখে না দেখলে বোঝানো কঠিন। তাঁর উদ্যোগটা চমৎকার। জুবায়েরের এই সবুজ আন্দোলনে খুব কম খরচে বেশি মানুষকে যুক্ত করা যাচ্ছে। জয়পুরহাটেও এই কার্যক্রম এ বছর শুরু করব।’ 

লক্ষ্য ১০ লাখ
যাদের লেখাপড়া শেষ হয়নি, তারা এখনই অন্তত একটি করে গাছের মালিক। জুবায়ের আল মাহমুদ বললেন স্বপ্নের কথা, ‘২০১৯ সালে আরও ১৫টি উপজেলায় আমরা বৃক্ষ রোপণ করব। ইউএনওদের সঙ্গে এ বিষয়ে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়েছে।’ তাঁর লক্ষ্য, ২০১৯ সালে সারা দেশে অন্তত ১০ লাখ গাছের চারা রোপণের। আর এভাবেই বাংলাদেশের সব শিক্ষার্থীকে নিয়ে বছরের নির্দিষ্ট একটি দিনে বৃক্ষ রোপণ করার স্বপ্ন দেখেন জুবায়ের।