এই বাড়িতে টুনটুনিরা বাসা বাঁধে, উড়ে বেড়ায় পানকৌড়ি
হ্যাঁ পাঠক, শিরোনামে যা পড়ছেন, তা সত্যি। তবে সেটা নদীর কোনো পাড় নয়, কিংবা নয় কোনো জলাজঙ্গল। এটা একটা বাড়ি। ঢাকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটারের মধ্যে, সাভারের হেমায়েতপুরের যে এলাকায় বাড়িটা, তার আশপাশে সব গতানুগতিক দালানকোঠা। একটু তফাতে চারপাশে তৈরি পোশাক আর ট্যানারির বড় বড় কারখানা।
এই বাড়িটাও দালান। তবে দেয়ালগুলো যে ইট-কংক্রিটের, হাত দিয়ে ছুঁয়ে না দেখলে বোঝা ভার। নামের মতোই এ বাড়ি সবুজে ঘেরা। বাড়ির নাম সবুজ পাতা, বাবা সবুজ সিদ্দিকী আর কন্যা পাতা অংরূপিণীর নামে। বাড়িটি দেখলেই নামকরণের সার্থকতা টের পাওয়া যায়। প্রকৃতি যেন নামটিকে সত্যি করে দিয়েছে।
গত বছর এশিয়ার স্থপতিদের সংস্থা আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়ার (আর্কেশিয়া) পুরস্কার ‘আর্কেশিয়া অ্যাওয়ার্ডস ফর আর্কিটেকচার ২০২১’ পেয়েছে এই বাড়ি। স্থপতি আছিয়া করিম ও স্থপতি নাঈম আহমেদ কিবরিয়ার নকশা করা বাড়িটি ‘ইনডিজেনাস সিঙ্গেল ফ্যামিলি রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট’ বিভাগে পেয়েছে সম্মাননা পুরস্কার।
বাড়ির দুটি বৈশিষ্ট্য অনন্য—বাইরে থেকে সবুজে ঘেরা আর ভেতরটাও যেন সবুজ প্রকৃতিরই অংশ। ভেতর বলতে বাড়ির প্রাঙ্গণের কথা বলছি না, বলছি অন্দরের কথা। দোতলার বারান্দা কখন এসে মিশে গেছে উঠানে, বোঝা ভার। আর নিচতলার বৈঠক আর লম্বা খাবার ঘরে যেন ঢুকে গেছে গোটা উঠান। দেয়াল–লাগোয়া সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। এই তলাতেই সবার শোবার ঘর। ২২০০ বর্গফুটের দোতলার ঘরগুলো বড়। আলো–বাতাসে ভরা। জানালাগুলো ভাঁজ করে পুরোটাই খুলে রাখা যায়। তবে নিচতলা ১৮০০ বর্গফুটের। দোতলার বাড়তি অংশ দক্ষিণমুখী বারান্দা, দোলনায় দুলতে থাকা ছোট্ট মাহাদী আর পাতার সঙ্গে দখিনা বাতাস সেখানে খেলা করে।
এ বাড়িতে কোনো গ্রিল নেই। বেশির ভাগ জানালাই দেয়ালজোড়া। কাঠের ফ্রেমে কাচের জানালা। কবজা দিয়ে সেগুলো ভাঁজ করেও রাখা যায়।
সবুজ সিদ্দিকী জানালেন, কোনো ঘরেই শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) নেই। বাতাসের সঞ্চালন এত ভালো যে গরমকালেও ফ্যান দিয়েই কাজ চলে। দোতলার ছাদের একটা অংশে শুধু এসি আছে। সেটা সবুজের স্টুডিও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে ছাপচিত্রে স্নাতকোত্তর সবুজ একজন চিত্রশিল্পী। তাই বানিয়ে নিয়েছেন এই স্টুডিও। ফ্যাশন হাউস দেশালের অন্যতম অংশীদার সবুজ। সবুজ পাতার পাশেই আরও দুই অংশীদার সংগীতশিল্পী কনক আদিত্য ও ডিজাইনার ইশরাত জাহান দম্পতির কাঠের দোতলা বাড়ি। গাছপালা ছাওয়া ছোট্ট পুকুরসহ সেই বাড়িও প্রকৃতির অংশ।
সবুজের বাড়িতে প্রকৃতির আধিপত্যই বেশি। সন্তানেরা উঠান দাপিয়ে, পাড়া মাতিয়ে, গাছপালা, ফুল–লতা–পাতা, পাখি দেখে শৈশব কাটাবে—নগর সংস্কৃতিতে এখন যা ভাবাই যায় না—এই বাড়িতে সেটাই সম্ভব করেছেন সবুজ সিদ্দিকী–কাজী তানিয়া ফারজানা দম্পতি। দারুণ আরেক বিষয় হলো স্নানঘরসহ বাড়ির যেখানেই বসা যাক না কেন, সরাসরি বা একটু ঘাড় ঘুরিয়ে সবুজ প্রকৃতি চোখে পড়বে। ফলে সবুজ প্রকৃতির সঙ্গেই বেড়ে উঠছে এই বাড়ির দুই সন্তান মাহাদী ও পাতা।
আগেই বলেছি, বাইরে থেকে দেখলে সবুজ পাতার দেয়াল দেখা যায় না, মনে হয় ঝোপঝাড়ে ঘেরা। বাড়ির দেয়ালগুলো ঘিরে রেখেছে লতানো সব গাছ। মধুমালতী, মাধবীলতা, বাসরলতা ছেয়ে আছে গোটা বাড়ি। গাছের শিকড়ে দেয়ালের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, তাই লতানো গাছ বেছে নেওয়া হয়েছে—জানালেন কাজী তানিয়া। ফলের গাছ, ফুলের গাছ আছে অনেক রকম। বাড়ির উঠানে জলে ভাসত শাপলা–পদ্ম। মাহাদী নেহাতই শিশু, তাই আপাতত সে জায়গা ভরাট করে রাখা হয়েছে। এই এত এত গাছপালার কারণেই পাখিদের গন্তব্য ‘সবুজ পাতা’। লতানো গাছের ঝোপে বাসা বানায় ঘুঘু, টুনটুনিরা।
সবুজ পাতা এত সবুজ আর প্রাণময় কেন? স্থপতি আছিয়া করিমের ব্যাখ্যা, ‘জায়গার জলবায়ু বুঝে প্রকৃতি থেকে যা যা নেওয়া যায়, সেসব আমরা আমাদের স্থাপনায় চর্চা করি। অনেক আগে থেকে প্রকৃতি এখানে যেমন ছিল, নকশায় সেটাই ধরে রাখার চেষ্টা করেছি। আমাদের দেশের ল্যান্ডস্কেপ একটু জংলা ধরনের। যতটুকু পারা যায়, সেটাও ধরে রাখা হয়েছে এই বাড়িতে।’
সে কারণে পুরস্কারজয়ী এই স্থাপত্য বিচ্ছিন্ন কোনো দালান হয়ে ওঠেনি, হয়েছে প্রকৃতির অংশ—যেটি কমবেশি সব ঋতুতে পাখপাখালিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, ফোটাচ্ছে ফুল, ছড়াচ্ছে সৌরভ।