এ বছর কারিকোর নোবেল বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না
২০১৩ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন র্যান্ডি শেকম্যান। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলের অধ্যাপক। বিশ্ববিদ্যালয়টির এ বছরের সমাবর্তন বক্তা ছিলেন তিনি।
সারা বছরের মধ্যে সমাবর্তনই আমার সবচেয়ে প্রিয় অনুষ্ঠান। দীর্ঘ এই অভিজ্ঞতায় কত কী–ই না দেখেছি। অনলাইন সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে গাউনের নিচে কিছুই না পরা থেকে শুরু করে অফলাইন সমাবর্তনে মঞ্চে উঠে ডিগবাজি খাওয়া—স্নাতকের শিক্ষার্থীরা সবই পারে।
এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত যেসব অপ্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে মাথা ভরে রেখেছিলে, নিশ্চিন্তভাবেই এখন তা ফেলে দিতে পারো। বিলি কলিন্সের ‘ফরগেটফুলনেস’ কবিতার মতো করেই বলি—গ্রিক পুরাণের ৯ মিউসের নাম, দ্বিঘাত সমীকরণ অথবা গ্রহগুলোর ক্রমবিন্যাস—কিছুই মনে রাখার দরকার নেই আজ। বিগত ৪ বছর যে হাসি, খেলা ও গানের স্মৃতি পরিপূর্ণ করেছে তোমার জীবন, তার ভিড়ে হারিয়ে যেতেই পারে কোষের শক্তির হিসাবের সমীকরণ।
আমি মনে করি, বিগত কয়েক বছরে যেসব তথ্য দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লেকচার আর দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরানো হয়েছে, এর বাইরেও তোমাদের আমরা কিছু দিতে পেরেছি। এ অনুষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পথে মনে করে দেখো, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমি প্রথম দিন কে ছিলে, আর এখন কে। যদি আমরা বিজয়ী হয়ে থাকি, তবে তুমি এখন অনেক বেশি সচেতন একজন মানুষ। সাধারণ জ্ঞানের সত্যতাও তুমি নিজের মতো যাচাই করতে চাইবে। ওষুধ কোম্পানি যখন অলৌকিক কোনো নিরাময় তোমার কাছে বেচতে চাইবে—তখন তুমি স্বপ্ন না দেখে সত্য খুঁজতে নামবে। এমনকি বিখ্যাত নোবেল বিজয়ী বার্কলে প্রফেসরও যদি তোমার ওপর তার অনর্থক মতবাদ চাপিয়ে দিতে যায়, তা-ও তুমি মেনে নিয়ো না। তোমার চেতনার বিকাশেই আমাদের বিজয়, পরিপূর্ণতায় নয়।
এগিয়ে চলার গল্প
আমার মতো যাঁদের অ্যামিনো অ্যাসিড বা সেগুলোর জেনেটিক কোড মনে রাখা লাগে না, তাঁরা কেন বছরের পর বছর একই লেকচার, একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করে যাই? কারণ, আমরা নিশ্চিত জানি, প্রতিবছর ক্লাসরুমগুলোতে তোমাদের বুদ্ধিদীপ্ত উৎসুক মুখগুলো দেখতে পাব। খুদে গবেষকদের প্রচেষ্টায় যখন কোষের এক কোণের রহস্য আবিষ্কৃত হয়, অথবা বিস্তৃত হয় ইতিহাসের কোনো পাতা—সেই আবিষ্কারের জাদুতেই আমাদের সার্থকতা।
জনশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার উদাহরণ হিসেবে তোমাদের বলতে চাই কাটালিন কারিকোর কথা, যার অসামান্য গবেষণা ও আবিষ্কার মহামারির মধ্যে লাখো জীবন বাঁচিয়েছে। কারিকো ছিলেন একজন হাঙ্গেরীয় শরণার্থী। বড় হয়েছেন ফ্রিজ, টেলিভিশন, এমনকি পরিষ্কার পানিবিহীন এক বাড়িতে। তার কাছে ছিল শুধু ইউনিভার্সিটি অব জাগ্রেবের বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের একটি পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি আর ঝুড়িভরা স্বপ্ন। বিদেশ পাড়ি জমান তাঁর স্বামী, ছোট্ট মেয়ে এবং তার টেডি বিয়ারটাকে নিয়ে। সেই টেডি বিয়ারের ভেতরে লুকিয়ে রাখেন নিজের গাড়ি বিক্রি করা কষ্টের টাকা। যুক্তরাষ্ট্রে এসে যাযাবরের মতো এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে উড়ে বেড়ান বেশ কয়েক দিন। অবশেষে ঠাঁই হয় পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল নিজের এমআরএনএ (মেসেঞ্জার আরএনএ) বিষয়ক গবেষণা এগিয়ে নেওয়া। অনেক বছরের সাধনার পরও গবেষণায় সার্থক না হওয়ায় সেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হয়। ড্রিউ ওয়াইজম্যান নামের এক সহকর্মী তাঁকে নিজের ল্যাবের একটা বেঞ্চে কাজ করার জায়গা করে দেন। সেই সহকর্মীর সাহায্যে কারিকো নিজের গবেষণার ভুলগুলো শুধরাতে সক্ষম হন। যুগান্তকারী একটি আবিষ্কার করার পরেও যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সুপরিচিত জার্নালে তাঁর কাজ প্রকাশিত হয়নি। আবার ইউরোপে ফিরে যোগদান করেন বায়োএনটেক কোম্পানিতে, যা ফাইজারের আর্থিক সাহায্য পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে মডার্নার সমতুল্য টিকা তৈরি করেছে।
এ বছর কারিকোর নোবেল বিজয় কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমার সৌভাগ্য যে তাঁর সঙ্গে আমার সামনাসামনি দেখা করার সুযোগ হয়েছে। তাঁর জীবনের শত প্রতিকূলতা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করেছিলাম। যে উত্তর তিনি দিয়েছেন, সেটা আমি কখনো ভুলব না। তিনি বলেন, ‘আর কিছু না হোক, আমার নিজের একটা ল্যাব বেঞ্চ তো ছিল। আর আমি আমেরিকাতে ছিলাম। এটাই তো অনেক বড় পাওয়া।’ আমাদের দেশে প্রবাসীদের ওপর নানা অবিচারের পরও শুধু একটা ল্যাব বেঞ্চ নিয়েই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখেছেন কারিকো।
ভবিষ্যতের জন্য
আমি জানি আজ এই মিলনায়তনেই আরও অনেক প্রবাসীর সংগ্রামের গল্প আছে। আমার সহধর্মিণী ড. সাবিহা মার্চেন্ট সুদূর ভারত থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে এ দেশে আসেন শুধু শিক্ষার সুযোগ খুঁজতে। এই মুহূর্তে পৌঁছানোর জন্য আপনাদের মধ্যে যাঁরা লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে এসেছেন, তাঁদের জানাই স্যালুট। আপনাদের জন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয়।
আমি এমন একটা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে ছিলাম, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশা ছিল, কিন্তু টাকার দুশ্চিন্তাও ছিল। তবে সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচটা গ্রীষ্মকালের চাকরি দিয়েই চালিয়ে নিতে পেরেছি। প্রথম বর্ষেই কাজ করতে পেরেছি নোবেল বিজয়ী উইলার্ড লিবির সঙ্গে। তিনি সি-১৪ আবিষ্কার করেন প্রাগৈতিহাসিক উপকরণ ব্যবহার করে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে কাজ করেই আমার কোষবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ জন্মায়। তবে সেকাল আর একালের মধ্যে অনেক তফাত। আমার মতো অনেক ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানী শুধু আকাশচুম্বী খরচের ভয়ে আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার স্বাদ নিতে পারছে না। আমার জমানায় ছাত্ররা প্রায় বিনা মূল্যেই পড়াশোনা করেছে। আর এখন বৃত্তি পেতে হারকিউলিসের মতো পরীক্ষা দিতে হয়।
আমাদের পরিবার–পরিজন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত—জনশিক্ষার পথটা আগের মতো সুগম করা। আমি যে চমৎকার শিক্ষা এখানে পেয়েছি, আমাদের ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীরাও যেন সেটাই পায়। (সংক্ষেপিত)